আর বিপ্লব
ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোতে নির্বাচন শুধু ভোটদানের প্রক্রিয়া নয়; এটি জনগণের ইচ্ছা প্রকাশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কিন্তু নির্বাচন যদি প্রভাবমুক্ত না হয়, প্রশাসন যদি নিরপেক্ষতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়, তাহলে গণতন্ত্রের ভিত কেঁপে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনকালীন প্রশাসনিক পক্ষপাত, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এই বাস্তবতায় “SIR”—Special Independent Region—ধারণাটি, যেখানে নির্দিষ্ট এলাকায় নির্বাচনকালীন বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হবে, তা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে।
নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। যখন শাসকদল প্রশাসনিক যন্ত্রকে প্রভাবিত করে, পুলিশ থেকে ব্লক অফিস পর্যন্ত রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠে, তখন বিরোধী দল ও সাধারণ ভোটারের আস্থা ভেঙে যায়। SIR এই পরিস্থিতিতে একটি বিকল্প মডেল উপস্থাপন করতে পারে—যেখানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রশাসন সরাসরি নির্বাচন কমিশনের অধীনে পরিচালিত হবে এবং স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে।
SIR-এর অন্যতম যুক্তি হলো নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। ভোটের সময় রাজনৈতিক সংঘর্ষ, বুথ দখল, ভুয়ো ভোট, এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। যদি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে নির্বাচনের সময় নিরাপত্তা বাহিনী, প্রশাসনিক কর্মী, এমনকি নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত সমস্ত ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।
দ্বিতীয়ত, SIR হতে পারে ভোটারের আস্থার পুনর্গঠনের হাতিয়ার। বহু মানুষ মনে করেন, তাদের ভোটের ফল আগেই নির্ধারিত হয়ে যায় প্রশাসনিক পক্ষপাতের কারণে। যখন ভোটার জানবেন যে তার এলাকায় নির্বাচনকালীন সময় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, তখন ভোটদানে আগ্রহ ও অংশগ্রহণ উভয়ই বাড়বে। এটি গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি—ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
তৃতীয়ত, SIR প্রক্রিয়া দুর্নীতি ও অনিয়ম কমাতে সাহায্য করবে। নির্বাচনকালীন সময়ে আর্থিক প্রলোভন, মদ বিতরণ, বা অন্যান্য অবৈধ কার্যকলাপ রাজনৈতিক দলগুলির অন্যতম হাতিয়ার। যদি নির্বাচনের সময় SIR কাঠামোর অধীনে আর্থিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের উপর কঠোর নজরদারি থাকে, তাহলে এই ধরনের অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে।
চতুর্থত, SIR ধারণা আঞ্চলিক বৈষম্য কমাতে সাহায্য করতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, কিছু এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পর্যবেক্ষকের উপস্থিতি থাকলেও অন্য এলাকায় প্রশাসনিক শিথিলতার কারণে অনিয়ম বেড়ে যায়। SIR কাঠামোতে পুরো অঞ্চলকে সমান গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হবে, যাতে প্রতিটি ভোটারের অধিকার সমানভাবে সুরক্ষিত থাকে।
এটি বাস্তবায়নের জন্য SIR-কে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। একটি স্পষ্ট নীতি থাকতে হবে, যেখানে বলা থাকবে—কোন পরিস্থিতিতে এবং কোন এলাকায় SIR কার্যকর হবে, কে এর নেতৃত্ব দেবে, কীভাবে নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় হবে। এখানে প্রযুক্তির ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ; ইলেকট্রনিক নজরদারি, লাইভ স্ট্রিমিং, বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন ইত্যাদি যুক্ত করলে SIR কাঠামো আরও কার্যকর হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর রাজ্যে SIR-এর প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র। গত কয়েক দশকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের সময় বিরোধী দলগুলি শাসকদলের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসনের অভিযোগ তুলেছে। এর ফলে আদালত পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেছে এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু এই ব্যবস্থাও অনেক সময় কার্যকর হয়নি কারণ স্থানীয় প্রশাসনের উপর রাজনৈতিক প্রভাব পুরোপুরি কমেনি। যদি SIR কাঠামো চালু হয়, তাহলে নির্বাচনকালীন প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত। বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক দেশে, বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশে, নির্বাচনকালীন বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল বা ‘Election Zones’ চালু রয়েছে, যা নিরপেক্ষতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সফল হয়েছে। ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় ও রাজনৈতিকভাবে জটিল দেশে এই ধরনের কাঠামো শুধু প্রয়োজনীয় নয়, বরং অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে।
শেষ পর্যন্ত, SIR কেবল একটি প্রশাসনিক কাঠামো নয়—এটি জনগণের আস্থার পুনর্গঠন, গণতন্ত্রের মান রক্ষা, এবং ভবিষ্যতের রাজনীতিকে সুষ্ঠু পথে চালিত করার ভিত্তি। যদি আমরা সত্যিই চাই যে ভোট হোক মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন, রাজনৈতিক প্রভাবের নয়, তাহলে SIR-এর মতো একটি মডেল নিয়ে এগোনো সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে প্রমাণ করা যাবে, ভারত শুধু গণতন্ত্রের সংখ্যা নয়, মানেও বিশ্বে শীর্ষে।