পিয়া রায়
চীন মূলত বৌদ্ধ, তাওবাদী এবং কনফুসিয়ান দর্শনের প্রভাবশালী দেশ হলেও, ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আসা বিপুল সংখ্যক প্রবাসীর কারণে এখানে দুর্গাপুজো একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আয়োজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে হংকং, গুয়াংজু, শাংহাই এবং বেইজিং শহরে বসবাসরত বাঙালি, বিহারী ও অন্যান্য ভারতীয় কমিউনিটির মানুষ প্রতিবছর দুর্গাপুজো আয়োজন করেন। হংকংয়ে এর প্রচলন বহু পুরোনো, প্রায় কয়েক দশক আগে কিছু বাঙালি পরিবার মিলে ছোট পরিসরে প্রতিমা স্থাপন ও পুজোর আয়োজন শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে স্থানীয় ভারতীয় সাংস্কৃতিক সমিতি ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সহায়তায় এই পূজা আয়োজন বড় আকার ধারণ করে। বর্তমানে হংকংয়ে Bengali Association of Hong Kong ও Hong Kong Bharat Sanchar দুর্গাপুজোর প্রধান আয়োজক হিসেবে পরিচিত। এখানে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন দেবীর পূজা, অঞ্জলি, সন্ধ্যা আরতি এবং প্রসাদ বিতরণ অনুষ্ঠিত হয়।
শাংহাই ও বেইজিং শহরেও প্রবাসী ভারতীয় ও বাংলাদেশি পরিবারগুলি মিলিত হয়ে দুর্গাপুজো করেন। যদিও সেখানে পূজার পরিধি হংকংয়ের মতো বড় নয়, তবুও সাংস্কৃতিক চেতনার গভীরতা স্পষ্ট। শাংহাইয়ের পূজা মূলত ভারতীয় বাণিজ্যিক কমিউনিটির উদ্যোগে হয় এবং এতে প্রবাসী শিক্ষার্থী ও পরিবাররা অংশগ্রহণ করেন। বেইজিংয়েও ভারতীয় দূতাবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র পূজার আয়োজনে সহায়তা করে থাকে। অন্যদিকে গুয়াংজু ও শেনজেন অঞ্চলে বাংলাদেশি বাঙালিরাও দুর্গাপুজো করে, যেখানে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ থাকে উল্লেখযোগ্য।
চীনের দুর্গাপুজোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে উৎসবটি শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, বরং এটি এক মহা সাংস্কৃতিক মেলায় পরিণত হয়। প্রবাসী পরিবারগুলো ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে মণ্ডপে আসেন, রান্না হয় লুচি, খিচুড়ি, পায়েসসহ দেশীয় খাবার, আর ঢাক ও কাশরের বাদ্যে তৈরি হয় একেবারে দেশীয় পরিবেশ। পূজার পাশাপাশি আয়োজিত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় থাকে গান, নাচ, নাটক ও আবৃত্তি, যা নতুন প্রজন্মকে শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে। শিশু-কিশোররা আবৃত্তি, নৃত্য ও সংগীতে অংশগ্রহণ করে, যাতে তারা প্রবাসে থেকেও নিজেদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের গর্ব অনুভব করতে পারে।
হংকংয়ের দুর্গাপুজোতে স্থানীয় চীনা নাগরিকদেরও অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়। তারা কৌতূহলবশত মণ্ডপে আসেন এবং ভারতীয় সংস্কৃতির নানা দিক প্রত্যক্ষ করেন। এর ফলে আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ভারত-চীনের জনগণের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন তৈরি হয়। একইসঙ্গে প্রবাসীরা অনুভব করেন যে, দেশ থেকে দূরে থেকেও দুর্গাপুজোর মাধ্যমে তারা নিজেদের পরিচয় ও ঐতিহ্যকে অটুট রাখতে পারছেন।
আজ চীনে দুর্গাপুজো কেবল প্রবাসী হিন্দুদের ভক্তির প্রতীক নয়, বরং এটি বাঙালি ও ভারতীয় সংস্কৃতির বিশ্বায়িত রূপ। মণ্ডপে ঢাকের শব্দ, ধুনোর গন্ধ আর আরতির আলো প্রমাণ করে, ভৌগোলিক সীমানা যত দূরেই হোক না কেন, মাতৃসত্তার আরাধনা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক গর্বকে কোনো সীমারেখা থামিয়ে রাখতে পারে না। ফলে চীনের দুর্গাপুজো আজ প্রবাস জীবনের আবেগ, ঐক্য ও সাংস্কৃতিক গর্বের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
ছবি: সংগৃহীত