পিয়া রায়
নিউজিল্যান্ডে দুর্গাপুজো এখন প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এক অনন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপ রাষ্ট্রে বাঙালিদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও, উৎসবের উচ্ছ্বাস ও আয়োজনের পরিধি কোনো অংশেই কম নয়। এখানে দুর্গাপুজো মূলত অকল্যান্ড, ওয়েলিংটন, ক্রাইস্টচার্চ ও হ্যামিলটনের মতো বড় শহরগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ভারতীয় প্রবাসী সম্প্রদায়ের বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মানুষ সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
প্রথম দিকে, ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে, নিউজিল্যান্ডে দুর্গাপুজো ছিল অত্যন্ত ঘরোয়া আয়োজন। কয়েকটি পরিবার মিলে কোনো বাড়ির বসার ঘরে প্রতিমার ছবি সাজিয়ে চণ্ডীপাঠ, ভোগ রান্না ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূজা সম্পন্ন হতো। সময়ের সঙ্গে প্রবাসী বাঙালিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং সংগঠিত রূপ নেয় পূজা। আজ ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজিল্যান্ড’ এবং বিভিন্ন শহরভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন দুর্গাপুজোর আয়োজন করে, যা বহু মাস আগে থেকেই পরিকল্পনা শুরু হয়।
এখানকার প্রতিমা প্রায়ই কলকাতা বা কুমোরটুলি থেকে অর্ডার দিয়ে আনা হয়, তবে স্থানীয় শিল্পীদের তৈরি প্রতিমাও সমানভাবে প্রশংসিত। পূজা অনুষ্ঠিত হয় স্কুল অডিটোরিয়াম, কমিউনিটি হল বা চার্চের বড় হলঘরে, যা কয়েক দিনের জন্য রূপ নেয় এক টুকরো বাংলায়। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত অঞ্জলি, আরতি, চণ্ডীপাঠ, ভোগ বিতরণ ও সন্ধ্যার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন কেবল বাঙালিরাই নয়, অন্যান্য ভারতীয় সম্প্রদায় এবং স্থানীয় কিউই নাগরিকরাও।
ভোগের আয়োজনেও থাকে খাঁটি বাঙালিয়ানা—গরম খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, টক ডাল, চাটনি, পায়েস—সবই স্বেচ্ছাসেবীদের হাতে রান্না হয়। মেনুতে মাঝে মাঝে নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় পণ্যের সংযোজন দেখা যায়, যেমন এখানকার তাজা সবজি বা ফল দিয়ে তৈরি বিশেষ পদ। পূজার সময় শাড়ি, পাঞ্জাবি, গয়না, মিষ্টি ও বইয়ের স্টল বসে, যা প্রবাসে থেকেও বাঙালি উৎসবের কেনাকাটার আনন্দকে জিইয়ে রাখে।
নিউজিল্যান্ডের দুর্গাপুজোর আরেকটি বিশেষ দিক হলো এর আন্তঃসাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। স্থানীয় কিউই বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়ে পূজার আসরে নিয়ে আসা হয়, যাতে তারা বাঙালি সংস্কৃতি, সংগীত ও খাবারের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। এই বিনিময় একদিকে যেমন সম্পর্ককে দৃঢ় করে, তেমনি বহুসাংস্কৃতিক সমাজে বাঙালির পরিচয়কে সমৃদ্ধ করে।
দশমীর দিন সিঁদুর খেলা, ঢাকের তালে নাচ, এবং প্রতিমা বিসর্জনের প্রতীকী আয়োজন হয়। যেহেতু সমুদ্রে বা নদীতে বিসর্জন দেওয়া সবসময় সম্ভব নয়, তাই অনেক সময় প্রতিমা পুনর্ব্যবহার বা সংরক্ষণ করা হয়, যা পরিবেশবান্ধব ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এখানকার পূজা কেবল ধর্মীয় আচার নয়, বরং প্রবাসী বাঙালির শিকড়ের সঙ্গে আবেগময় সংযোগ রক্ষার মাধ্যম। কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে কয়েকটি দিন একত্রিত হয়ে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া, আড্ডা, গান, নাচ, নাটক—সব মিলিয়ে এই উৎসব হয়ে ওঠে বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত সময়। নিউজিল্যান্ডের দুর্গাপুজো প্রমাণ করে, বাঙালির উৎসবপ্রিয়তা ভৌগোলিক সীমানা মানে না—যেখানেই বাঙালি আছে, সেখানেই দেবীর আগমন হয় ঢাকের তালে, আলো-আড়ম্বর ও মিলনের হাসিতে।
ছবি: সংগৃহীত