আর বিপ্লব
এক সময় মানুষ ভুল বলত, কিন্তু মিডিয়া সেই ভুল ধরিয়ে দিত। তারা অনুসন্ধান করত, তথ্য যাচাই করত, এবং সত্যকে তুলে ধরত জনসাধারণের সামনে। সত্য এক সময় ছিল সংবাদমাধ্যমের কাছে পবিত্র এক দায়িত্ব, এক ব্রত। কিন্তু সময় বদলে গেছে।
আজ পরিস্থিতি উল্টো। আজ মিডিয়া নিজেরাই ভুল বা বিকৃত তথ্য পরিবেশন করে, আর সাধারণ মানুষ নিজের চেষ্টা ও গবেষণায় সত্যটা খুঁজে বের করে। সত্য যেন হয়ে উঠেছে হারিয়ে যাওয়া এক রত্ন, যেটা পেতে হলে খনন করতে হয়, সন্দেহ করতে হয়, প্রশ্ন তুলতে হয়।
একটা সময় সংবাদমাধ্যমকে সমাজের চোখ ও কান বলে মনে করা হতো। তখন খবরের মান নির্ধারিত হতো তার নিরপেক্ষতা, বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি ও সত্যনিষ্ঠার মাধ্যমে। সংবাদ পরিবেশন ছিল দায়িত্বের কাজ।
কিন্তু এখন সংবাদ অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছে একধরনের পণ্য—যার মূল লক্ষ্য বাজার দখল, দর্শক বাড়ানো, এবং প্রভাব বিস্তার। সত্য সেখানে মুখ্য নয়, বরং যেটা বেশি ‘চলবে’ সেটাই দেখানো হয়।
মাঝেমধ্যেই দেখা যায়, ছোট্ট ঘটনাকে বড় করে তোলা হচ্ছে। ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন সেটাই জাতীয় সংকট। উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, নাটকীয়তা—এসব মিলিয়ে সংবাদ পরিবেশনে তৈরি হচ্ছে এক কৃত্রিম আবহ, যেখানে সত্য হারিয়ে যায় আবেগ ও কল্পনার ভিড়ে।
মানুষ আজ বুঝে গেছে, সব দেখা ও শোনা বিশ্বাস করা যায় না। তাই মানুষ নিজেরাই সোর্স খুঁজে নেয়। নিজেরাই ফ্যাক্ট চেক করে। কেউ ভিডিও দেখে ঘটনার প্রমাণ খোঁজে, কেউ বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করে মত গঠন করে।
একটি মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই এখন যে কেউ ঘটনার ভিডিও তুলতে পারে, সরাসরি সম্প্রচার করতে পারে। সত্য এখন আর শুধু অফিসে বসে লেখা হয় না, সেটা ঘটে মাটিতে, রাস্তার পাশে, মানুষের কণ্ঠে।
এখন মানুষ শুধু খবর পড়ে না, খবর বিশ্লেষণ করে। তারা জানতে চায়—কে বলছে, কেন বলছে, এবং কী লুকানো হচ্ছে। এই প্রশ্নগুলো থেকেই জন্ম নেয় এক নতুন ধরণের পাঠক—সচেতন, সন্দেহপ্রবণ, এবং অনুসন্ধিৎসু।
অনেক সময় দেখা যায়, কোনও বড় ঘটনা সংবাদমাধ্যমে চুপচাপ চাপা পড়ে থাকে। আর সেই সময় সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেই উঠে আসে এমন কেউ, যিনি ঘটনার ভেতরের সত্য তুলে ধরেন। কখনও একজন পথচলতি মানুষ নিজের মোবাইলে তুলে রাখে পুলিশের অন্যায় আচরণ, কখনও একজন শিক্ষার্থী সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরে গ্রাস করে চলা অন্যায়ের ছবি।
আজ সত্যকে খুঁজে বের করতে মানুষ ব্যবহার করে প্রযুক্তি, যুক্তি, ও নিজের বিবেক। তারা বিভিন্ন উৎস থেকে খবর মিলিয়ে দেখে। একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করে নেয় নিজস্ব অবস্থান। এই সচেতনতা গড়ে তুলছে এমন একটি সমাজ, যেখানে মানুষ অন্ধভাবে বিশ্বাস করে না, বরং প্রশ্ন তোলে, আলোচনায় অংশ নেয়, এবং সত্যের পেছনে ছুটে চলে।
এই পরিবর্তনের পেছনে বড় কারণ হলো, মানুষের মনের মধ্যে বেড়ে ওঠা একধরনের অবিশ্বাস। যখন কেউ বারবার দেখেছে যে বলা কথার সাথে বাস্তবের ফারাক আছে, তখন সে বিশ্বাস হারায়। তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয়—নিজেই সত্যটা খুঁজবে।
এই পরিবর্তন আমাদের সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন। এটি প্রমাণ করে, সত্য চাইলেই চাপা দেওয়া যায় না। সত্য দেরিতে আসতে পারে, কিন্তু সে আসে—মানুষের হাত ধরে, প্রশ্নের আলোর নিচে।
এই নতুন বাস্তবতায়, মানুষের নিজের দায়িত্বও বেড়ে গেছে। এখন একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেককেই জানতে হবে কীভাবে তথ্য যাচাই করতে হয়, কীভাবে উৎস বিশ্লেষণ করতে হয়, এবং কীভাবে গুজবের ফাঁদে না পড়ে সত্যের কাছাকাছি যাওয়া যায়।
তথ্যপ্রযুক্তি যেমন ভুল ছড়াতে পারে, তেমনই পারে ভুল ধরতেও। মানুষ এখন ছবি বিশ্লেষণ করে, শব্দের ভেতরের ইঙ্গিত পড়ে, এবং খুঁজে দেখে—যা বলা হচ্ছে, সেটার পেছনের উদ্দেশ্য কী।
এই সবকিছুর মাঝে সবচেয়ে বড় বার্তা হলো—মানুষ থেমে নেই। তারা খুঁজছে, শিখছে, প্রশ্ন তুলছে। আর সেই চেষ্টার মাধ্যমেই গড়ে উঠছে এক নতুন সংবাদচেতনা, যেখানে মানুষ নিজেই হয়ে উঠছে সত্যের পথিক।
এই যুগে সত্য আর কাগজের পাতায় ছাপা থাকে না। সেটা ছড়িয়ে পড়ে মানুষের হাত ধরে, মানুষের কণ্ঠে, মানুষের চোখে। কেউ চাপা দিতে চাইলেও, কেউ বিকৃত করতে চাইলেও—সত্য ঠিক খুঁজে নেয় নিজের পথ।
তাই আজ সত্য শুধু সাংবাদিকতার দায়িত্ব নয়—সেটা আমাদের সবার দায়িত্ব। সত্যকে রক্ষা করা, সত্যকে ছড়ানো, এবং সবচেয়ে বড় কথা—সত্যকে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া—এই আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
সত্য কখনও সহজ ছিল না। আজ তা আরও কঠিন। কিন্তু তবু মানুষ চেষ্টা করছে, কারণ সত্য ছাড়া গণতন্ত্র বাঁচে না, সমাজ গড়ে ওঠে না, মানুষ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না।
এখন সময় এসেছে, যখন মানুষ শুধু পাঠক নয়—তারা অনুসন্ধানকারী, বিশ্লেষক এবং প্রহরী।
মিডিয়া যদি সত্য লুকায়, মানুষ তা খুঁজে বের করবে—এই আশা নিয়েই সত্যের সন্ধান চলুক।