পিয়া রায়
মরিশাসে দুর্গাপুজো প্রবাসী ভারতীয় সমাজের অন্যতম প্রাচীন ও আবেগঘন উৎসব, যা এখানে শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দ্বীপদেশটি উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ ও বঙ্গ অঞ্চল থেকে আনা চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের মাধ্যমে এক বৃহৎ ভারতীয় প্রবাসী জনসংখ্যা গড়ে তোলে। তাঁদের সঙ্গে আসা দেবদেবীর পূজার রীতি, বিশেষ করে দুর্গাপুজো, এখানকার সংস্কৃতিতে স্থায়ী স্থান পায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি কেবল প্রবাসী বাঙালিদের নয়, মরিশাসের হিন্দু সম্প্রদায়ের সমগ্র অংশের একটি শারদীয় আয়োজন হয়ে উঠেছে।
মরিশাসে দুর্গাপুজো প্রধানত রাজধানী পোর্ট লুই, কিউরপাইপ, কুইত্র বর্ন, মহেবুরগ ও অন্যান্য শহর ও গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় মন্দির, হিন্দু সংগঠন ও বঙ্গীয় সমিতিগুলো এই আয়োজনের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এখানে প্রতিমা প্রায়শই স্থানীয় শিল্পীরা বানান, যদিও অনেক সময় ভারত থেকে মূর্তি আমদানিও করা হয়। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পূজার প্রতিটি আচার পালন করা হয় যথাযথ ভক্তি ও নিয়ম মেনে—চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলি, সন্ধিপুজো, আরতি ও ভোগ বিতরণ এই উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
দুর্গাপুজো মরিশাসে এক বিশাল সামাজিক উৎসবে রূপ নেয়, যেখানে বাঙালি ছাড়াও বহু ভোজপুরি, তামিল, মারাঠি, তেলেগু ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করে। পুজোর সময় মন্দির প্রাঙ্গণ ও কমিউনিটি সেন্টারগুলো রঙিন আলো, ফুল ও আলপনায় সজ্জিত হয়। ঢাক ও কাঁসরের ধ্বনি, ধূপের গন্ধ, আর ভক্তিমূলক গানের সুরে চারিদিকে শারদীয় আবহ তৈরি হয়, যা দ্বীপের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রেক্ষাপটেও বাংলার শরতের অনুভূতি ফিরিয়ে আনে।
ভোগ ও প্রসাদ এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েসের মতো ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পদ ছাড়াও এখানে পরিবেশিত হয় স্থানীয় স্বাদের সংমিশ্রণ—যেমন মরিশিয়ান ডালপুরি বা গেটো পিমঁ। খাবারের এই বহুমাত্রিকতা প্রমাণ করে কিভাবে সংস্কৃতি ও খাদ্যরীতি একে অপরকে সমৃদ্ধ করে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও দুর্গাপুজোর অপরিহার্য অংশ। বাংলা গান, রবীন্দ্রসংগীত, আবৃত্তি, নাটক, নৃত্যনাট্য থেকে শুরু করে বলিউড ও মরিশিয়ান লোকসংগীত—সবই এই মঞ্চে স্থান পায়। শিশুদের জন্য বিশেষ প্রতিযোগিতা ও পরিবেশনা আয়োজন করা হয়, যা প্রবাসে জন্মানো প্রজন্মকে শিকড়ের সঙ্গে পরিচিত করে। এর মাধ্যমে শুধু বিনোদন নয়, বরং ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজও এগিয়ে যায়।
মরিশাসে দুর্গাপুজো তাই নিছক ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি প্রবাসী ভারতীয় সমাজের ঐক্য, গৌরব ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রতীক। প্রতিবার শরৎ এলেই এই দ্বীপে যেন বাংলার একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ ফুটে ওঠে। দেবী দুর্গার আগমনে মানুষের মন ভরে ওঠে আনন্দে, আর তাঁর বিদায়ে আবেগে ভরে ওঠে প্রবাসী হৃদয়। এই উৎসব প্রমাণ করে, ভৌগোলিক দূরত্ব যতই হোক, মাতৃভূমির সংস্কৃতি ও অনুভূতি প্রবাসের মাটিতেও অটুট থাকে।
ছবি: সংগৃহীত