পিয়া রায়
নাইজেরিয়ায় দুর্গাপুজো এক ভিন্ন প্রবাসী আবহে উদযাপিত হয়, যেখানে ভারতীয় সম্প্রদায়, বিশেষ করে বাঙালি ও অন্যান্য হিন্দু প্রবাসীরা, তাঁদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জীবন্ত রাখেন। পশ্চিম আফ্রিকার এই বৃহত্তম দেশটি মূলত মুসলিম, খ্রিস্টান এবং স্থানীয় উপজাতীয় ধর্মবিশ্বাসীদের আবাস হলেও, গত কয়েক দশকে ব্যবসা, পেশাগত কাজ ও কূটনৈতিক কারণে ভারতীয়দের একটি ছোট কিন্তু সক্রিয় জনসংখ্যা এখানে গড়ে উঠেছে। তাঁদের মধ্যে বহু পরিবার কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ কিংবা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন, আর সেই সূত্রে দুর্গাপুজো তাঁদের প্রবাস জীবনের অন্যতম বড় উৎসব।
লাগোস, আবুজা ও পোর্ট হারকোর্ট শহরগুলোতে দুর্গাপুজোর আয়োজন সবচেয়ে বেশি হয়। সাধারণত ভারতীয় সাংস্কৃতিক সমিতি, হিন্দু মন্দির কমিটি বা প্রবাসী বাঙালি সংগঠন মিলিতভাবে এ আয়োজন করে। স্থানীয়ভাবে প্রতিমা নির্মাণের ব্যবস্থা না থাকায়, অনেক সময় ভারত থেকে মৃৎশিল্পী এনে প্রতিমা তৈরি করা হয়, অথবা আংশিকভাবে প্রস্তুত মূর্তি আমদানি করে স্থানীয়ভাবে রঙ ও সাজসজ্জা সম্পন্ন করা হয়। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত এখানে সমস্ত নিয়ম মেনে পূজা হয়—চণ্ডীপাঠ, পুষ্পাঞ্জলি, সন্ধিপুজো, আরতি ও ভোগ বিতরণের মধ্য দিয়ে প্রবাসের মাটিতেও মাতৃভূমির আবহ ফুটে ওঠে।
নাইজেরিয়ার দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় আচারেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি প্রবাসী সমাজের মিলনমেলা। পুজোর সময়ে ভারতীয়, বাংলাদেশি, নেপালি ও শ্রীলঙ্কানসহ দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীরা একত্রিত হন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন কিছু নাইজেরিয়ান বন্ধুবান্ধবও, যারা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি কৌতূহলী ও অনুরাগী। ভোগে পরিবেশিত হয় ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার—খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েস—তবে স্থানীয় স্বাদের প্রভাবও চোখে পড়ে, যেমন ঝাল মরিচ বা আফ্রিকান মশলার সংযোজন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এই আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ। শিশু-কিশোররা নাচ, গান, আবৃত্তি পরিবেশন করে, বড়রা নাটক বা সঙ্গীতানুষ্ঠান করেন, আর মঞ্চে শোনা যায় বাংলা গান থেকে বলিউড হিট পর্যন্ত। এর মাধ্যমে প্রবাসে জন্মানো প্রজন্ম তাঁদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে।
তবে নাইজেরিয়ায় দুর্গাপুজো আয়োজনের কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি, আমদানি প্রক্রিয়ার জটিলতা, এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা—এসবই আয়োজনকারীদের জন্য বড় বাধা। তবুও প্রতিবছর অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও সম্প্রদায়ের আন্তরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে উৎসবটি প্রাণবন্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
দশমীর দিনে সিঁদুর খেলা, প্রতিমা বিসর্জন ও দেবীর বিদায়ের মুহূর্তে প্রবাসী হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। বিসর্জনের জন্য নদী বা জলাশয় সহজলভ্য না হওয়ায় অনেক সময় প্রতিমা প্রতীকীভাবে বিসর্জন দেওয়া হয়, অথবা পরিবেশবান্ধব উপায়ে মাটিতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এইসব আয়োজন প্রমাণ করে, ভৌগোলিক দূরত্ব যতই হোক, দুর্গাপুজোর চেতনা ও আবেগ প্রবাসে থেকেও অটুট থাকে, এবং নাইজেরিয়ার মাটিতে এটি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এক সেতুবন্ধন—যা ভারতীয় সংস্কৃতিকে আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে নতুন রূপে বাঁচিয়ে রাখে।
ছবি: সংগৃহীত


