পিয়া রায়
যুক্তরাষ্ট্রে দুর্গাপুজো আজ এক বহুল পরিচিত ও বহুল উদযাপিত সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে যেখানে ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালি প্রবাসীদের বসতি রয়েছে। দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বিস্তৃত এই প্রবাসী সমাজ দুর্গাপুজোকে শুধু পূজা-অর্চনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং এটিকে এক বিশাল সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রজন্মান্তরের সংযোগের মঞ্চে রূপ দিয়েছে। নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, ইলিনয়, ফ্লোরিডা, ম্যাসাচুসেটস প্রভৃতি রাজ্যে দুর্গাপুজো আজ একটি বড় আকারের আয়োজন, যা স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টার, স্কুল অডিটোরিয়াম কিংবা ভাড়া করা হলঘরে অনুষ্ঠিত হয়। প্রবাস জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পূজার দিনগুলোতে সবাই সময় বের করে মিলিত হন, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেন এবং নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্যের স্বাদ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দুর্গাপুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রবাসী উপযোগী রূপ। এখানে মণ্ডপ ও প্রতিমা প্রায়শই কলকাতা বা বাংলাদেশের কারিগরদের হাতের তৈরি হলেও সেগুলি সমুদ্রপথে পাঠানো হয়, অথবা স্থানীয় শিল্পীরা আধুনিক উপকরণ দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করেন। পূজার আচারগুলি মূলত একই থাকে—চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলি, আরতি, ধুনুচি নাচ, সিঁদুর খেলা—তবে সময়সূচি অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়। প্রবাসীরা অনেক সময় সপ্তাহান্তে পূজার মূল আয়োজন করেন, যাতে কর্মজীবী মানুষ ও পড়াশোনারত তরুণ-তরুণীরা সহজে অংশ নিতে পারেন।
ভোগের আয়োজনও যুক্তরাষ্ট্রে এক বিশেষ আকর্ষণ। রান্নাঘরে স্বেচ্ছাসেবীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি ও পায়েস প্রস্তুত করেন, যা পূজার্থীদের মধ্যে পরিবেশন করা হয়। তবে স্থানীয় বাজারের উপকরণের ওপর নির্ভর করায় কিছু খাবারে আমেরিকান সবজি বা পণ্যের ব্যবহার দেখা যায়। এটি খাবারের স্বাদে সামান্য ভিন্নতা আনলেও প্রবাসীরা তা উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেন, কারণ এর মাধ্যমে পূজা আরও বহুমুখী হয়ে ওঠে।
দুর্গাপুজো যুক্তরাষ্ট্রে কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি এক সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। পূজার মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, আধুনিক গান, নাটক, আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশিত হয়, যেখানে শিশু থেকে প্রবীণ পর্যন্ত সকলে অংশগ্রহণ করে। এর ফলে নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয় এবং প্রবাস জীবনের মধ্যেও নিজের শিকড়ের সংস্পর্শে থাকে। অনেক পূজায় বিখ্যাত শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, যারা ভারত বা বাংলাদেশ থেকে এসে গান ও নাটক পরিবেশন করেন।
অন্য একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়। যুক্তরাষ্ট্রে দুর্গাপুজো প্রায়শই স্থানীয় আমেরিকান ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তারা ঢাকের তালে ধুনুচি নাচ শেখে, সিঁদুর খেলায় অংশ নেয় এবং ভোগের স্বাদ গ্রহণ করে। এতে শুধু প্রবাসী বাঙালিদের ঐতিহ্যই টিকে থাকে না, বরং তা অন্য সংস্কৃতির কাছেও পরিচিত হয়।
দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত প্রতীকীভাবে হয়। নদী বা জলাশয়ের বদলে অনেক সময় প্রতিমা সংরক্ষণ করে রাখা হয় বা কেবল প্রতীকী বিদায় দেওয়া হয়। তবে আবেগের দিক থেকে বিসর্জনের মুহূর্ত ঠিক ততটাই মর্মস্পর্শী, যতটা তা বাংলায় হয়।
সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে দুর্গাপুজো প্রমাণ করে যে প্রবাসে থেকেও ঐতিহ্যকে সজীব রাখা যায়। এটি শুধু একটি উৎসব নয়, বরং প্রবাসী বাঙালিদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এক অটুট বন্ধন সৃষ্টি করে এবং ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে মানুষকে একসূত্রে বেঁধে রাখে।
ছবি: সংগৃহীত

