পিয়া রায়
কাতার একটি ছোট উপসাগরীয় দেশ হলেও এখানে প্রবাসী বাঙালিদের উপস্থিতি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও ওড়িশার বহু মানুষ কর্মসূত্রে বা স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন কাতারে। তাঁদের সঙ্গে এসেছে সংস্কৃতি, উৎসব ও ঐতিহ্যের রঙ। সেই ধারাবাহিকতায় দুর্গাপুজো কাতারে আজ শুধু ধর্মীয় নয়, বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এখানকার পুজো মূলত প্রবাসী সংগঠনগুলির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। ‘কাতার বাংলা সমাজ’, ‘বাংলাদেশ সোশ্যাল ফোরাম’, কিংবা বিভিন্ন ভারতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতি বছর সরকারি অনুমোদন নিয়ে দুর্গাপুজোর আয়োজন করে।
কাতারের সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়মবিধি মেনে চলার প্রয়োজন হয়। তাই এখানকার পুজো সাধারণত কমিউনিটি সেন্টার, স্কুলের হল, বা নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ভেন্যুতে সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত হয়। তবে সেই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আবেগে ও ভক্তিতে কোনও ঘাটতি থাকে না। দূরদেশে থেকেও প্রবাসীরা মায়ের আগমনের অপেক্ষায় থাকেন সারা বছর। পাঁচ দিনব্যাপী পূজার সমস্ত আচার যেমন ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও বিজয়া দশমী যথাযোগ্য নিয়মে সম্পন্ন করা হয়। এখানে পুরোহিতরাও প্রবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য, যাঁরা মন্ত্রোচ্চারণ থেকে আরতি পর্যন্ত সবই নিষ্ঠার সঙ্গে পরিচালনা করেন।
প্রবাস জীবনের ক্লান্তি ও একাকিত্বকে ভোলানোর এক অনন্য অবলম্বন এই দুর্গোৎসব। পুজো উপলক্ষে কাতারের মাটিতে মিলিত হয় ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের বাঙালিরা। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, সান্ধ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্য, গান, নাটক—সবকিছু মিলে উৎসব পায় সমবেত আনন্দের রূপ। অনেক সময় ভারত, বাংলাদেশ কিংবা স্থানীয় শিল্পীরাও এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন। বাচ্চাদের জন্য থাকে বিশেষ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, যা প্রবাসী প্রজন্মকে নিজেদের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখে।
প্রসঙ্গত, কাতারে মূর্তিপুজো করার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ থাকায় অনেক সময় প্রতীকীভাবে ছবি বা ছোট মূর্তি ব্যবহার করা হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাতারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ প্রতিমা এনে মহালয়ার দিন থেকে সাজসজ্জার কাজ শুরু করা হয়। বিদেশের মাটিতে দুর্গাপুজোর প্রতিটি মুহূর্ত তাই প্রবাসীদের কাছে হয়ে ওঠে আরও আবেগঘন। বিজয়ার দিনে যেমন কলকাতা বা ঢাকায় সিঁদুর খেলা হয়, তেমনই কাতারেও প্রবাসী নারীরা সিঁদুর খেলে উদযাপন করেন বাঙালির চিরন্তন রীতি।
কাতারে দুর্গাপুজো নিছক ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি প্রবাস জীবনের এক সামাজিক বন্ধন, বাঙালি পরিচয়ের সাংস্কৃতিক প্রতীক। সীমিত পরিবেশেও যে ঐতিহ্যের আলো নিভে যায় না, বরং আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তার বাস্তব প্রমাণ এই দেশের দুর্গোৎসব। এখানকার প্রতিটি পুজো প্রবাসী বাঙালির আত্মপরিচয়, মিলনমেলা এবং ঐতিহ্য রক্ষার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি।
ছবি: সংগৃহীত