পিয়া রায়
ওমান উপসাগরীয় অঞ্চলের এমন এক দেশ যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয় ও বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মসূত্রে বসবাস করেন। এই প্রবাসীদের মধ্যে বাঙালি সম্প্রদায়ের উপস্থিতি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, আর তাঁদের সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ দুর্গাপুজো। ধর্মীয়ভাবে ইসলাম প্রধান দেশ হলেও, ওমান সরকার প্রবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ দিয়ে থাকে। সেই সুযোগকেই বাঙালি ও অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ রূপ দেন এক মহোৎসবে—দূরদেশের মাটিতে দুর্গাপুজো।
ওমানে দুর্গাপুজোর আয়োজন সাধারণত ভারতীয় সামাজিক সংগঠন, প্রবাসী সমিতি এবং স্থানীয় হিন্দু মন্দির কমিটির উদ্যোগে হয়ে থাকে। মাস্কাট, সালালাহ ও সোহারের মতো শহরগুলোতে প্রবাসীরা সরকারি অনুমতি নিয়ে দুর্গোৎসব আয়োজন করেন। এখানে পূজার স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়—প্রায়শই স্কুলের অডিটোরিয়াম, কমিউনিটি হল বা ভারতীয় সামাজিক ক্লাবের প্রাঙ্গণ। ওমানের রাজধানী মাস্কাটের Shri Krishna Temple প্রবাসী হিন্দুদের ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে দুর্গাপুজোও বিশেষ আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়। পূর্ণাঙ্গ প্রতিমা, সাজসজ্জা, আলোকসজ্জা এবং মন্ত্রোচ্চারণে সেখানে ভক্তি ও আনন্দের আবহ তৈরি হয়।
ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পুজোর সমস্ত নিয়মকানুন যথাযথভাবে পালিত হয়। মহাসপ্তমীর নবপত্রিকা স্থাপন, মহাঅষ্টমীতে অঞ্জলি প্রদান, সন্ধিপুজো, আরতিসহ সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। প্রবাসী পুরোহিতরাই মূলত এই দায়িত্ব পালন করেন। বিজয়া দশমীর দিন সিঁদুর খেলা, প্রসাদ বিতরণ এবং একে অপরকে শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়ে সমগ্র পরিবেশ ভরে ওঠে আবেগে ও আনন্দে। যদিও এখানে প্রতিমা বিসর্জন সম্ভব নয়, তবুও প্রতীকীভাবে প্রতিমা বিসর্জনের পরিবর্তে বিদায়-অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
ওমানে দুর্গাপুজোর আরেকটি বড় আকর্ষণ হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় বাঙালি ও অন্যান্য ভারতীয় প্রবাসীরা নৃত্য, সংগীত, আবৃত্তি ও নাটকের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হন। শিশুদের জন্য বিশেষ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়, যাতে তারা নিজেদের শিকড় ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারে। বিভিন্ন প্রবাসী শিল্পী ছাড়াও কখনও কখনও ভারত বা বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত শিল্পীরা যোগ দেন এই অনুষ্ঠানে।
ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রবাসীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দুর্গোৎসবকে ওমানের মাটিতে বাঙালি পরিচয়ের অন্যতম প্রধান প্রতীক করে তুলেছে। এখানে পুজো কেবল দেবী আরাধনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে এক সামাজিক বন্ধন, প্রবাস জীবনের ক্লান্তি ভুলে মিলনমেলার আনন্দে ভেসে ওঠার উপলক্ষ। দূরত্ব ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রবাসীরা প্রতি বছর নতুন উদ্যমে দুর্গাপুজো আয়োজন করে চলেছেন, যা প্রমাণ করে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নয়। ওমানের দুর্গাপুজো তাই একদিকে ভক্তির প্রতিফলন, অন্যদিকে প্রবাসী জীবনের উজ্জ্বল রঙিন ক্যানভাস।
ছবি: সংগৃহীত