পিয়া রায়
বাহরাইন উপসাগরীয় অঞ্চলের একটি ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র হলেও এখানে বহু ভারতীয় ও বাঙালি প্রবাসী দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। তাঁদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু দুর্গাপুজো। ইসলাম প্রধান দেশ হলেও বাহরাইন সরকার প্রবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহনশীল এবং অনুমতি প্রদান করে থাকে। ফলে প্রতিবছর শরৎকাল এলেই প্রবাসী বাঙালি ও ভারতীয় সম্প্রদায় মহাসমারোহে দুর্গোৎসব পালন করেন, যা প্রবাস জীবনের এক অন্যতম আকাঙ্ক্ষিত অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে।
বাহরাইনে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল প্রায় চার দশক আগে, ভারতীয় ও বাঙালি প্রবাসীদের উদ্যোগে। প্রথমে এটি সীমিত পরিসরে, ব্যক্তিগত বাসভবনে বা ছোট আকারের হলে আয়োজিত হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রবাসী সমাজের বৃদ্ধি ও সংগঠনের প্রসারে আজ এটি এক বিশাল উৎসবে পরিণত হয়েছে। রাজধানী মানামার Bahrain Bengali Cultural Society ও Bangladesh Club ছাড়াও ভারতীয় সামাজিক সংগঠনগুলো দুর্গাপুজো আয়োজন করে থাকে। পূজা সাধারণত ক্লাব প্রাঙ্গণ, ভাড়া করা অডিটোরিয়াম কিংবা কমিউনিটি হলে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সরকারি অনুমতি নিয়ে প্রতিমা স্থাপন, মণ্ডপসজ্জা ও সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।
ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পূজার সমস্ত নিয়ম কানুন নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়। সপ্তমীর নবপত্রিকা স্থাপন, অষ্টমীতে অঞ্জলি ও কুমারী পূজা, নবমীতে মহাসন্ধি পূজা এবং দশমীতে বিজয়া অনুষ্ঠান প্রবাসীদের মনে গভীর আবেগ জাগায়। যদিও এখানে প্রতিমা বিসর্জন করা সম্ভব নয়, তবুও প্রতীকী বিসর্জনের মাধ্যমে দেবীর বিদায় অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। সিঁদুর খেলা, প্রসাদ বিতরণ এবং বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময়ে ভক্তি ও আনন্দের আবহ তৈরি হয়।
পুজোর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এই উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি ও নাট্য পরিবেশনা। প্রবাসী শিল্পীরা ছাড়াও কখনও কখনও বাংলাদেশ ও ভারত থেকে আমন্ত্রিত শিল্পীরা অংশ নেন। শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়, যাতে তারা নিজেদের শিকড় ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে বাহরাইনের প্রবাসী সমাজ মিলনমেলায় ভরে ওঠে, যেখানে ধর্মীয় ভক্তি ও সাংস্কৃতিক আনন্দ একসঙ্গে মিলেমিশে যায়।
বাহরাইনের দুর্গাপুজো শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং প্রবাসী বাঙালি ও ভারতীয়দের জন্য এটি হয়ে উঠেছে এক পরিচয়ের প্রতীক। বিদেশের মাটিতে থেকেও নিজেদের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রাখার দৃঢ় মানসিকতার প্রকাশ এই উৎসব। ভৌগোলিক দূরত্ব কিংবা সাংস্কৃতিক ভিন্নতা প্রবাসীদের মনে কখনও পূজোর আবেগকে কমিয়ে দিতে পারেনি। বরং এই আবেগই তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করে, প্রবাস জীবনের ক্লান্তি ভুলিয়ে তোলে এবং নব উদ্যমে ভরিয়ে দেয়। তাই বাহরাইনের দুর্গাপুজো আজ প্রবাসী সমাজের গর্ব ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উজ্জ্বল প্রতিফলন।
ছবি: সংগৃহীত