পিয়া রায়
কুয়েত উপসাগরীয় অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র, যেখানে বহু ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি প্রবাসী দীর্ঘদিন ধরে কর্মসূত্রে বসবাস করছেন। প্রবাস জীবনের ব্যস্ততা ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার মাঝেও তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয়কে সযত্নে লালন করেন। এর অন্যতম প্রকাশ দুর্গাপুজো, যা কুয়েতের বাঙালি প্রবাসীদের কাছে শুধুই একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এক গভীর আবেগের উৎসব। প্রতিবছর শরৎকালে যখন ভারতের আকাশে শারদীয় আগমন ঘটে, তখন সেই আবেগের ঢেউ কুয়েতেও এসে পৌঁছায় এবং প্রবাসীদের জীবনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে।
কুয়েতে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল কয়েক দশক আগে প্রবাসীদের উদ্যোগে। প্রথমে ছোট আকারে, ভাড়াকরা বাড়ি বা সীমিত হলঘরে পূজা অনুষ্ঠিত হলেও এখন এটি এক মহোৎসবে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে Kuwait Bengali Cultural Society এবং অন্যান্য সামাজিক সংগঠন পূজার আয়োজন করে থাকে। পূজা সাধারণত বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার বা অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সরকারি অনুমতি নিয়ে প্রতিমা স্থাপন, মণ্ডপসজ্জা এবং সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। সরকারের অনুমতি ও আইন মেনে পূজার সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, যা কুয়েতের ধর্মীয় সহনশীলতার একটি উদাহরণ।
ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন নির্দিষ্ট নিয়মে পূজার্চনা হয়। সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্থাপন, অষ্টমীতে কুমারী পূজা ও সপরিবার অঞ্জলি প্রদান, নবমীতে মহাসন্ধি পূজা এবং দশমীতে দেবীর প্রতীকী বিসর্জন প্রবাসীদের মনে গভীর আবেগ জাগায়। এখানে বাস্তবে বিসর্জন সম্ভব নয় বলে প্রতিমা পরবর্তী সময়ে যথাযথ রীতিতে সংরক্ষণ বা ভাঙন করা হয়। তবে সিঁদুর খেলা, প্রসাদ বিতরণ এবং বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময়ে উৎসবের উচ্ছ্বাস একটুও কমে না।
কুয়েতের দুর্গাপুজো শুধুমাত্র পূজার আচারেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি প্রবাসী সমাজের এক বড় সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। পূজার দিনগুলোতে সন্ধ্যার আসরে অনুষ্ঠিত হয় সংগীত, নৃত্য, নাটক, আবৃত্তি ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। স্থানীয় শিল্পীরা ছাড়াও ভারত ও বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত শিল্পীরা অনেক সময় উপস্থিত থাকেন। শিশু-কিশোরদের জন্যও বিশেষ প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি থাকে, যাতে তারা নিজেদের শিকড় ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে।
প্রবাসের ব্যস্ত জীবনে দুর্গাপুজো হয়ে ওঠে এক মিলনমেলা। আত্মীয়-স্বজনের অভাব হলেও প্রবাসী সমাজের সকলে মিলে একে অপরের পরিবার হয়ে ওঠেন। ভক্তি, আনন্দ ও মিলনের এই আবহ মানুষকে নব উদ্যমে ভরিয়ে তোলে। কুয়েতের দুর্গাপুজো তাই শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি প্রবাসীদের ঐক্য, পরিচয় ও সাংস্কৃতিক গর্বের প্রতীক। বিদেশের মাটিতে থেকেও নিজেদের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রাখার দৃঢ় মানসিকতার প্রকাশ এই উৎসব, যা প্রমাণ করে যে ভৌগোলিক দূরত্ব যতই থাকুক না কেন, দুর্গাপুজোর আবেগ কখনও ম্লান হয় না।
ছবি: সংগৃহীত