পিয়া রায়
সংযুক্ত আরব আমিরাত মূলত মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও এখানে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক ভারতীয় প্রবাসীর কারণে দুর্গাপুজো এক বিশেষ সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মানুষ এই উৎসবের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। প্রবাস জীবনের একঘেয়েমি ও দেশ থেকে দূরে থাকার কষ্টের মাঝে শারদীয়া দুর্গাপুজো প্রবাসী বাঙালির জন্য আনন্দ, ভক্তি ও মিলনের এক অনন্য উপলক্ষ। এখানে পূজা শুধু দেবী দুর্গার আরাধনা নয়, বরং ঐতিহ্য, পরিচয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রকাশ।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুর্গাপুজোর সূচনা প্রায় তিন দশক আগে প্রবাসী বাঙালিদের ক্ষুদ্র উদ্যোগে হয়েছিল। প্রথমদিকে ছোট পরিসরে ভাড়াকরা ঘরে বা সীমিত স্থানে প্রতীকী প্রতিমা স্থাপন করে পূজা অনুষ্ঠিত হতো। ধীরে ধীরে প্রবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক চেতনার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পূজার আয়োজন বড় আকার ধারণ করে। বর্তমানে দুবাই, আবুধাবি, শারজাহ, আল আইন ও রাস আল খাইমাহ-সহ বিভিন্ন এমিরেটে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় সাংস্কৃতিক সংস্থা, সামাজিক সংগঠন ও প্রবাসী কমিউনিটি একসঙ্গে মিলিত হয়ে সরকারি অনুমতি নিয়ে এই উৎসবের আয়োজন করে থাকে।
দুবাইয়ের Bengali Cultural Society of UAE এবং Abu Dhabi Puja Committee সবচেয়ে বড় আয়োজক হিসেবে পরিচিত। এখানে পূজার দিনগুলোতে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিনই সম্পূর্ণ আচার অনুযায়ী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তমীর নবপত্রিকা প্রবেশ, অষ্টমীর কুমারী পূজা, নবমীর মহাসন্ধি পূজা এবং দশমীর সিঁদুর খেলা প্রবাসীদের মধ্যে এক গভীর আবেগ সৃষ্টি করে। যেহেতু সমুদ্র বা নদীতে প্রতিমা বিসর্জন সম্ভব নয়, তাই পূজার শেষে প্রতিমা যথাযথ রীতিতে ভাঙন করা হয়। কিন্তু এই প্রতীকী বিসর্জনও প্রবাসীদের চোখে জল আনে, কারণ এতে দেশ ছেড়ে আসা স্মৃতিগুলো যেন আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুর্গাপুজো শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি এক বিরাট সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। পূজার দিনগুলোতে সন্ধ্যায় আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকে গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি ও ফ্যাশন শো। প্রবাসী শিল্পীরা যেমন অংশগ্রহণ করেন, তেমনি ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেক সময় জনপ্রিয় শিল্পীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। শিশু-কিশোরদের জন্য চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও নৃত্য প্রতিযোগিতা থাকে, যাতে তারা প্রবাস জীবনে থেকেও নিজেদের শিকড় ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারে।
সবচেয়ে বড় দিক হলো এই উৎসব প্রবাসীদের মধ্যে একতা ও বন্ধনের সেতুবন্ধন তৈরি করে। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে কয়েকদিনের বিরতি নিয়ে সবাই পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের নিয়ে মিলিত হন। দেশ থেকে দূরে থেকেও এই উৎসব তাদের মনে করিয়ে দেয় শিকড়ের টান এবং সাংস্কৃতিক গর্বের গুরুত্ব। দুর্গাপুজোর মাধ্যমে প্রবাসীরা কেবল দেবী দুর্গার আরাধনাই করেন না, বরং নিজেদের ঐক্য, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়কে নতুন করে উপলব্ধি করেন। ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুর্গাপুজো আজ প্রবাসী বাঙালির আবেগ, ভক্তি ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক শক্তিশালী প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত