পিয়া রায়
দক্ষিণ কোরিয়া মূলত বৌদ্ধ ও কনফুসিয়ান ঐতিহ্যে গড়ে ওঠা একটি দেশ হলেও এখানে বসবাসরত ভারতীয় প্রবাসী ও দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটির কারণে দুর্গাপুজো একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিশেষত সিউল, ইনচন এবং বুসানের মতো শহরে প্রবাসী বাঙালি ও ভারতীয় সংগঠনগুলির উদ্যোগে প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়। যদিও দক্ষিণ কোরিয়ায় এই উৎসবের সরকারি ছুটির প্রচলন নেই, তবুও স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজের সহযোগিতায় প্রবাসীরা মিলিত হয়ে মাতৃসত্তার আরাধনা করেন। এতে কেবল ধর্মীয় ভক্তিই প্রকাশ পায় না, বরং প্রবাসজীবনের একাকিত্ব ভেঙে গড়ে ওঠে নতুন বন্ধনের সেতুবন্ধন।
সিউলে দুর্গাপুজো উদযাপনের প্রচলন শুরু হয় প্রায় দুই দশক আগে, অল্প কয়েকজন বাঙালি পরিবারের মাধ্যমে। তারা প্রাথমিকভাবে ঘরোয়া পরিবেশে মন্ত্রোচ্চারণ ও প্রতীকী প্রতিমা স্থাপনের মাধ্যমে পূজার আয়োজন করতেন। ধীরে ধীরে ভারতীয় দূতাবাস ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহায়তায় পূজার পরিধি বাড়তে থাকে। বর্তমানে সিউলে Bengali Association of Korea এবং Indian Cultural Centre—এই দুটি সংগঠন বড় আকারে দুর্গাপুজো আয়োজন করে। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিনই মন্ত্রোচ্চারণ, আরতি, প্রসাদ বিতরণ এবং সন্ধ্যাকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিমা বিসর্জনের পরিবর্তে এখানে প্রতিমা প্রতীকীভাবে ভাঙন করা হয় বা পরবর্তী বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি এক বিশাল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। পূজার সময় প্রবাসী বাঙালি ও ভারতীয় পরিবারগুলি ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে অংশ নেন, রান্না হয় লুচি, আলুর দম, খিচুড়ি, পায়েসসহ নানা বাঙালি খাবার। পূজা মণ্ডপে ভেসে আসে ধুনোর গন্ধ, শোনা যায় ঢাকের বাদ্য, যা প্রবাসে থেকেও দেশীয় আবহ তৈরি করে। সন্ধ্যায় আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, আধুনিক গান, নাচ ও নাটক। শিশুরা আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে প্রকাশ করে, যা প্রবাস জীবনের পরবর্তী প্রজন্মকে শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত রাখার এক মহৎ প্রচেষ্টা।
এই উৎসব প্রবাসীদের জন্য শুধু আনন্দই নয়, একধরনের আবেগময় অভিজ্ঞতাও বটে। দেবী দুর্গার আগমনে তারা অনুভব করেন মাতৃভূমির টান, পারিবারিক ঐতিহ্যের গর্ব এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের গভীরতা। পাশাপাশি স্থানীয় কোরিয়ান নাগরিকরাও এই পূজার সঙ্গে যুক্ত হন কৌতূহলবশত, এবং এতে গড়ে ওঠে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ। অনেকে ভারতীয় সংস্কৃতি, শিল্প ও আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন। এর ফলে দুর্গাপুজো দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবাসী ভারতীয়দের পরিচয়কে সুদৃঢ় করে তোলার পাশাপাশি দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধনও গভীর করে।
আজ দক্ষিণ কোরিয়ার দুর্গাপুজো প্রবাসী বাঙালির কাছে শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি সাংস্কৃতিক ঐক্য, প্রবাসজীবনের সহমর্মিতা এবং বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে শিকড়ের প্রতি অটল টানের প্রতীক। বিদেশের মাটিতে থেকেও এই পূজা প্রমাণ করে, মাতৃসত্তার আরাধনা ও বাঙালিয়ানা ভৌগোলিক সীমারেখা মানে না, বরং মানুষের হৃদয়ে গড়ে তোলে সর্বজনীন মিলনের উৎসব।
ছবি: সংগৃহীত