আর বিপ্লব
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান ছিল এক ঐতিহাসিক বাঁক। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দলটি এক নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা করে। উন্নয়ন, পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি, এবং বাম শাসনের ক্লান্তি থেকে মুক্তির স্বপ্ন—সবকিছু মিলিয়ে তৃণমূল তখন বিপুল জনসমর্থন পায়। পরবর্তী দুই নির্বাচনে (২০১৬ ও ২০২১) বিজেপির উত্থানের মধ্যেও দলটি ক্ষমতায় থেকে তাদের সংগঠন ও ভোটব্যাংকের শক্তি প্রদর্শন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কার্যকলাপ কি এই শক্তিকে ধরে রাখতে পারবে? এই প্রশ্ন এখন ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে অন্যতম বড় সুবিধা হলো তাদের সুসংহত ভোটব্যাংক, বিশেষত গ্রামীণ ও সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে। গত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতা করে, কৃষক ও গরিব মানুষের জন্য একাধিক প্রকল্প (যেমন—লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, ছাত্রঋণ মওকুফ) চালু রেখে তারা এই সমর্থন মজবুত করার চেষ্টা করেছে। বিশেষত গ্রামীণ নারীদের মধ্যে লক্ষ্মীর ভান্ডার কর্মসূচি দলটির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মূলধন তৈরি করেছে।
তবে এই শক্তি ধরে রাখার পথে কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ, বিশেষত নিয়োগ কেলেঙ্কারি, কয়লা ও গরু পাচার মামলা, এবং একাধিক শীর্ষ নেতার গ্রেপ্তার, তৃণমূলের ভাবমূর্তিতে আঘাত হেনেছে। বিরোধীরা এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন’ আখ্যা দিচ্ছে, যা শহুরে শিক্ষিত ভোটার এবং তরুণ প্রজন্মের একাংশকে বিরূপ করছে। পাশাপাশি, কর্মসংস্থানের অভাব ও শিল্প বিনিয়োগের স্থবিরতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সাম্প্রতিক সময়ে তৃণমূলের রাজনৈতিক কৌশল লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, তারা রাজ্যে বিজেপির প্রভাব ঠেকাতে এবং একইসঙ্গে কংগ্রেস-বাম ঐক্যের প্রাসঙ্গিকতা কমাতে দ্বিমুখী লড়াই চালাচ্ছে। বিজেপি-বিরোধী মঞ্চে জাতীয় স্তরে নিজেদের সক্রিয় রেখে, রাজ্যে তারা বিরোধীদের ‘অবিশ্বস্ত’ হিসেবে তুলে ধরছে। কিন্তু এই কৌশল ভোটারদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা নির্ভর করছে তারা দুর্নীতি ইস্যুতে কতটা আস্থা পুনর্গঠন করতে পারে তার উপর।
অন্যদিকে, তৃণমূলের শক্তির আরেকটি বড় উৎস তাদের তৃণমূল পর্যায়ের সাংগঠনিক কাঠামো। পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে বুথ পর্যায়ে কার্যকর নেটওয়ার্ক তাদের নির্বাচনী যন্ত্রকে শক্তিশালী করে রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে সহিংসতার অভিযোগ এবং ভোটারদের মধ্যে ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে সমালোচিত হয়েছে। এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে ভোটার আস্থার ক্ষয় অনিবার্য।
বিরোধী শূন্যতার সুযোগ নিয়ে তৃণমূল এতদিন ধরে ক্ষমতা ধরে রেখেছে, কিন্তু বিজেপি ধীরে ধীরে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় নিজেদের প্রভাব বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ, জঙ্গলমহল এবং কিছু শহুরে অঞ্চলে বিজেপির ভোটশেয়ার তৃণমূলের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক এখনও তৃণমূলের প্রধান ভরসা হলেও, যদি কোনও কারণে এই ভোটে ফাটল ধরে, তবে ক্ষমতার ভারসাম্য দ্রুত পাল্টে যেতে পারে।
তৃণমূলের সাম্প্রতিক জনসংযোগ কর্মসূচি ও উন্নয়ন প্রচারমূলক উদ্যোগে লক্ষ্যণীয় যে তারা শহুরে মধ্যবিত্ত ও তরুণ ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই শ্রেণি এখন বেশি করে স্বচ্ছতা, কর্মসংস্থান এবং দক্ষ প্রশাসনের প্রত্যাশা করছে। শুধুমাত্র ভর্তুকি-ভিত্তিক কর্মসূচি দিয়ে তাদের সমর্থন দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখা কঠিন হতে পারে।
জাতীয় রাজনীতির সমীকরণও তৃণমূলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রভাব ফেলবে। যদি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বিজেপি বজায় থাকে, তবে রাজ্যে তৃণমূলের উপর চাপ বাড়বে; কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত এবং প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা তাদের শাসনের সক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। অন্যদিকে, যদি বিজেপি দুর্বল হয়, তবে তৃণমূল আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, বিশেষত যদি তারা বিরোধী ঐক্যে নিজেদের প্রভাবশালী অবস্থান ধরে রাখতে পারে।
সব মিলিয়ে, তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তি ধরে রাখা নির্ভর করছে তিনটি মূল বিষয়ের উপর—দুর্নীতি সংক্রান্ত আস্থা পুনর্গঠন, কর্মসংস্থান ও শিল্পে দৃশ্যমান অগ্রগতি, এবং গ্রামীণ-শহুরে ভোটারদের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সমর্থন বজায় রাখা। যদি এই ক্ষেত্রগুলিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যায়, তবে দলটি তাদের ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু যদি বর্তমান দুর্বলতাগুলি অব্যাহত থাকে, তবে আগামী দিনে তৃণমূলের জন্য ক্ষমতার রাস্তা আরও কঠিন হয়ে উঠবে, এবং হয়তো ধীরে ধীরে ক্ষয়ের পথে যাবে এই দীর্ঘদিনের আধিপত্য।