আর বিপ্লব
সমাজে একজন পুরুষের সম্মান, মর্যাদা, গ্রহণযোগ্যতা—সব কিছুই যেন এক সুতোয় বাঁধা, আর সেই সুতোটির নাম ‘অর্থ’। একজন নারীর ক্ষেত্রে সৌন্দর্য, আবেগ, সহানুভূতি বা মমতার মতো গুণাবলী যেমন সমাজে মূল্যায়িত হয়, তেমন একজন পুরুষের মূল পরিচয় যেন হয়ে দাঁড়ায়—সে কতটা উপার্জনক্ষম। তার প্রেম, তার কর্তৃত্ব, এমনকি আত্মসম্মান সবকিছু যেন পরিমাপ করা হয় তার টাকার মাপে। এই সমাজে পুরুষকে জন্ম থেকেই শেখানো হয়—“তুমি উপার্জন না করলে, তোমার কোনও মূল্য নেই।”
একজন পুরুষ যখন অর্থের অভাবে পড়েন, তার সবচেয়ে প্রথম ধাক্কা আসে নিজের পরিবার থেকেই। সন্তানের স্কুল ফি, স্ত্রীর ওষুধ, পিতার চিকিৎসা, মায়ের চোখের চশমা, সংসারের মাসিক বাজার, কিংবা বোনের বিয়ের খরচ—এইসব ছোট ছোট অথচ বিশাল দায়িত্বে প্রতিনিয়ত তাকে একা লড়তে হয়। যেদিন এই চাহিদা পূরণ হয় না, সেদিন পরিবারের সদস্যদের চোখে তার প্রতি নিরব অভিমান জমে ওঠে। কেউ হয়তো মুখে কিছু বলে না, তবে কথার মধ্যে, আচরণে কিংবা চোখের দৃষ্টিতে উঠে আসে অপমান, অভিযোগ আর হতাশা। সন্তান হয়তো বলে বসে, “আমার বন্ধুর বাবা তো...”—এই তুলনা যেন তীর হয়ে বিদ্ধ করে এক বাবার আত্মসম্মান। তখন নিজের স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা—যারা সবচেয়ে কাছের, তারাই যেন হয়ে ওঠে সবচেয়ে দূরের। একজন পুরুষ বুঝে ওঠে, তার বাড়িই আর তার আপন ঘর নয়।
==========
‘সাতসকাল’ ই-খবরের কাগজ আবার প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। অনুগ্রহ করে ফেসবুক পেজটি লাইক করুন এবং ইনবক্সে আপনার মূল্যবান পরামর্শ ও মতামত জানান।
==========
ভালোবাসা নিঃস্বার্থ, এটা আমরা শিখেছি ছোটবেলা থেকে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। একটি সম্পর্কের ভিত গড়তে বা তা টিকিয়ে রাখতে আজ অর্থ একটি বড় ভূমিকা রাখে। প্রেমের সময় হয়তো মেয়েটি বলে, “টাকা দরকার নেই, শুধু তুমি থাকো।” কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যখন তার বন্ধুদের প্রেমিকেরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, দামি উপহার দেয়, বিদেশে নিয়ে যায়—তখন সে চুপচাপ হলেও একটা অদৃশ্য প্রশ্ন করে, “তুমি কবে নিজের অবস্থান তৈরি করবে?” দাম্পত্য জীবনে এই চাপ আরও প্রকট হয়ে ওঠে। একটি বাড়ি, একটি গাড়ি, একটি নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থান—এসব না থাকলে অনেক সময় ভালোবাসাও দুর্বল হয়ে পড়ে। পুরুষটি তখন ভাবে, “সে কি আমাকে ভালোবাসে, না আমার টাকাকে?”
এই সমাজে টাকা নেই মানেই পুরুষ ব্যর্থ। এমনকি সে নিজের চেষ্টায় অনেক দূর এগোলেও, যদি তার উপার্জন কম হয়, তাহলেই সে সমাজে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আত্মীয়স্বজনের আড্ডায় তার কথা উঠে এলেও, মানুষ বলে, “সে তো এখনো কিছু করতে পারল না।” পাড়ার দোকানে বা বন্ধুর জন্মদিনে সবাই যখন চাকরি বা ব্যবসার গল্প করে, তখন সে নিশ্চুপ থাকে, যেন তার থাকার কোনও অধিকারই নেই। বন্ধুদের কেউ ব্যাঙ্কে, কেউ কর্পোরেট জগতে, কেউ বিদেশে, আর সে হয়তো বেকার বা ছোট চাকরিতে—তখন তাকে নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলা হয়, হয়তো সরাসরি নয়, কিন্তু পরোক্ষভাবে যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয়—“তুমি আমাদের মতো নও।” তখন তার মনে হয়, সমাজের কাছে সে কি শুধুই একটি ‘অর্থহীন ব্যর্থতা’?
যখন টাকাই মূল মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়, তখন পুরুষ তার নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। গান গাওয়ার ইচ্ছা, লেখালেখি, সিনেমা বানানো, নিজের একটা ছোট ব্যবসা শুরু করা—এসব স্বপ্ন চোখে থাকলেও সেগুলো হয় সংসারের খরচে গুমরে মরতে থাকে। প্রতিদিনের চাপ, চাহিদা, দায়িত্ব আর সামাজিক চাপের কাছে তার নিজের চাওয়া-মনের কথা কোনও গুরুত্ব পায় না। সে হয়তো প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি ছুটছে, কিন্তু কিসের জন্য? নিজের জন্য নয়, সমাজে টিকে থাকার জন্য, পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। দিন শেষে সে বুঝতে পারে, তার অস্তিত্ব একেকটি দায়ভার বইবার ভারী কাঁধ মাত্র।
বলা হয়, “টাকা দিয়ে সব কেনা যায় না।” নিঃসন্দেহে এই বাক্য সত্য, কিন্তু “টাকা না থাকলে কেমন লাগে”—এই সত্যটি আরও নির্মম। সন্তানের চিকিৎসার জন্য হাত পাততে হয়, স্ত্রীর প্রয়োজন মেটাতে না পারার গ্লানি বুকে চাপা পড়ে, বাবা-মায়ের বৃদ্ধ বয়সের নিরাপত্তা দিতে না পারার ব্যর্থতা চোখের পাতা ভেজায়। প্রেমিকার জন্মদিনে কিছু উপহার দিতে না পারার যন্ত্রণায় সে চুপ করে থাকে। তখন সে বোঝে, টাকা না থাকলে শুধু দরিদ্র হওয়া নয়—তুমি হয়ে ওঠো সমাজের চোখে অপ্রয়োজনীয়। অনুভবের কথা বলা চলে না, কারণ সমাজ শোনে শুধু অর্জনের ভাষা।
আমরা কখনও কি ভেবে দেখেছি, সেই মানুষটি যার কাঁধে এইসব দায়িত্ব, সেই পুরুষটি কি আদৌ মানুষ হিসেবে জায়গা পাচ্ছে? তার কষ্ট কি কেউ বোঝে? তার অভিমান, হতাশা, ক্লান্তি—এইগুলো কি প্রকাশের জায়গা পায়? না, বরং তাকে বলা হয়, “পুরুষ হয়ে কাঁদছো?” পুরুষের কান্না সমাজে নিষিদ্ধ, তার দুর্বলতা লজ্জার, তার পরাজয় অসম্মানজনক। যেন সে কোনও অনুভূতিহীন যন্ত্র, যাকে শুধু চালিয়ে যেতে হবে, ইনকাম করতে হবে, আর কোনও অভিযোগ না করেই সব সহ্য করতে হবে। এই নিষ্ঠুর মানসিকতা পুরুষদের এক নিষ্প্রাণ জীবনে ঠেলে দেয়, যেখানে তারা শুধু বেঁচে থাকে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ‘জীবিত’ থাকে না।
এই অবস্থার দায় কি শুধুই সমাজের? না কি আমাদের পরিবার, আমাদের নিজস্ব চাহিদাগুলোও এই দায় তৈরি করছে? যখন আমরা একজন পুরুষের কাছে ভালোবাসার বদলে নিরাপত্তা চাই, অনুভবের বদলে আয় চাই—তখন আমরা তাকে কেবল অর্থের যন্ত্রে পরিণত করি। টাকার প্রতি ঘৃণা নয়, কিন্তু টাকার প্রয়োজনকে অবজ্ঞা করাও অন্যায়। এই সমাজে বেঁচে থাকতে হলে, সম্মান পেতে হলে, পরিবারকে রক্ষা করতে হলে অর্থ প্রয়োজন। তাই অর্থ উপার্জনকে তুচ্ছ বা অপবিত্র ভাবার কোনও যুক্তি নেই। বরং একজন পুরুষের এই উপার্জনের সংগ্রামকে সম্মান করা উচিত। তাকে বুঝতে দেওয়া উচিত যে, সে শুধু উপার্জনের মেশিন নয়—সে একজন মানুষ, যার অনুভূতি, স্বপ্ন, ভালোবাসা সবই আছে।
একজন পুরুষ যখন টাকা ছাড়া সমাজে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, তখন সে শুধু দরিদ্র নয়—সে হয় সবচেয়ে অবহেলিত, সবচেয়ে একা, সবচেয়ে অবজ্ঞাত। তার আত্মসম্মান বারবার পদদলিত হয়, তার অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সমাজের চোখে তখন শুধু একটাই প্রশ্ন, “তুমি কতটা উপার্জন করো?” অথচ কেউ জিজ্ঞেস করে না, “তুমি কেমন আছো?” কেউ বুঝতে চায় না, “তুমি নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিচ্ছো কিনা।” এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতা দরকার, পরিবারে ভালোবাসার নতুন সংজ্ঞা প্রয়োজন। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই বার্তা পৌঁছানো দরকার—পুরুষের মূল্য টাকা দিয়ে মাপা যাবে না।
এখনও যদি সমাজ না বদলায়, যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টায়, তবে প্রতিটি পুরুষের জীবন এক অন্তহীন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে থাকবে। যেখানে তাকে প্রতিদিন লড়তে হবে শুধুমাত্র একটি অস্ত্র নিয়ে—টাকা। আর প্রতিদ্বন্দ্বী? তার নিজের পরিবার, প্রেম, সমাজ, আত্মসম্মান—সব কিছুই। আর সেই যুদ্ধে সে প্রতিদিন একটু একটু করে হেরে যাবে—ভেতরে ভেতরে। বাহ্যিকভাবে সে হয়তো হাসবে, দায়িত্ব পালন করবে, সফলতার মুখোশ পরবে—কিন্তু তার মন থাকবে ক্ষতবিক্ষত। কারণ একজন পুরুষ যখন অর্থের অভাবে ভালোবাসাহীন, সম্মানহীন, স্বপ্নহীন হয়ে ওঠে, তখন সে কেবল একজন দরিদ্র ব্যক্তি নয়—সে হয় এক জীবন্ত অথচ অবহেলিত অস্তিত্ব।