পিয়া রায়
আজ জগন্নাথদেবের শুভ রথযাত্রা। ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রথযাত্রা একটি অন্যতম পবিত্র ও জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব। এই রথযাত্রা মূলত ওড়িশার পুরী শহরের শ্রীজগন্নাথ ধামে অনুষ্ঠিত হয়। হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য ও বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে এই উৎসব শুধুমাত্র ভারতেই নয়, সারা বিশ্বের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক অবিস্মরণীয় তীর্থযাত্রা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের দীঘায় রাজ্য সরকারের উদ্যোগে নির্মিত একটি জগন্নাথ মন্দির এবং সেখানে আয়োজিত রথযাত্রা এই ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন্দ্র করেই এক বিতর্ক ও রাজ্যগত সংঘাতের সূত্রপাত করেছে।
পুরীর ঐতিহাসিকতা ও জগন্নাথ ধামের মাহাত্ম্য
শ্রীজগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা—এই তিন দেবতার রথযাত্রা পুরীর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কথিত আছে, দ্বাপরযুগে কৃষ্ণ এই রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রায় ৮০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজা অনঙ্গভীমা দেও কর্তৃক নির্মিত পুরীর জগন্নাথ মন্দির এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। UNESCO-র হেরিটেজ ট্যাগ পাওয়ার দাবি তোলা এই মন্দিরে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী আসেন রথের উৎসবে অংশ নিতে।
পুরীর রথযাত্রা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য। এখানে রথ টানার মাহাত্ম্য, ‘চক্র’ দর্শনের পবিত্রতা, এবং ‘গুন্ডিচা’ যাত্রার ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীর কাছে এক অনন্য বার্তা দেয়।
দীঘার নতুন জগন্নাথ মন্দির ও বিতর্ক
২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার দীঘায় একটি বিশাল জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। মন্দিরটির নকশা পুরীর আদলে তৈরি এবং সেখানে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তি স্থাপন করে রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। মন্দির নির্মাণের সময় রাজ্য সরকার এটিকে “জগন্নাথ ধাম” হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিল পর্যটন উন্নয়নের জন্য।
এই ঘোষণার পরই ওড়িশায় শুরু হয় প্রবল প্রতিবাদ। ওড়িশাবাসীর মতে, “জগন্নাথ ধাম” শুধুমাত্র পুরীকেই বোঝায়। এটি একটি হাজার বছরের পুরোনো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। দীঘার মন্দিরকে ধাম বলা হলে তা তাদের ধর্মীয় গৌরব এবং ঐতিহ্যের ওপর আঘাত বলেই অনেকে মনে করেন।
ওড়িশা সরকারের পক্ষ থেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানানো হয়। সোশ্যাল মিডিয়া ও রাজ্য রাজনীতিতেও এই ইস্যু নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার মন্দিরের নাম থেকে ‘ধাম’ শব্দটি বাদ দিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে এটিকে “দীঘা জগন্নাথ মন্দির” বলেই পরিচিত করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক তর্জা ও ধর্মীয় আবেগের সংঘাত
এই ইস্যুকে ঘিরে দুই রাজ্যের মধ্যে একটি সুপ্ত রাজনৈতিক সংঘাতও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন ওড়িশা সরকার এবং তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে পরোক্ষ টানাপোড়েন দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে। দীঘার মন্দির নির্মাণ ও ‘ধাম’ শব্দ প্রয়োগ সেই সংঘাতের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, রাজ্যে বিজেপির পক্ষ থেকেও এই উদ্যোগকে ‘হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত’ বলে চিহ্নিত করা হয়। তৃণমূল কংগ্রেস এটিকে পর্যটন কেন্দ্রিক উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ বলে ব্যাখ্যা করে। ধর্মীয় আবেগকে হাতিয়ার করে রাজনীতির ময়দানে একে-অপরকে আক্রমণের নতুন সুযোগ তৈরি হয়।
ধর্মীয় অনুভূতি না কি পর্যটন রাজনীতি?
প্রশ্ন উঠছে—জগন্নাথ মন্দির দীঘায় নির্মাণের পিছনে কি সত্যিই ধর্মীয় উদ্দেশ্য, না কি এর নেপথ্যে রয়েছে পর্যটন ও অর্থনৈতিক সুবিধার লক্ষ্য? দীঘা হলো পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় সমুদ্রতট পর্যটন কেন্দ্র। রাজ্য সরকার সেখানে একটি বৃহৎ ধর্মীয় মন্দির তৈরি করে বাড়তি পর্যটক টানতে চাইছে, এমনটাই অনেকের মত।
তবে এতে বিরোধ নেই যে মন্দিরটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে নির্মিত হয়েছে এবং স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও ধর্মীয় উৎসাহ তৈরি করেছে। কিন্তু যখন একই ধর্মীয় চিহ্ন ‘ধাম’ হিসেবে দাবিকরা হয়, তখন তা ঐতিহাসিক মর্যাদার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
সমাধান কোন পথে?
ধর্মীয় বিশ্বাস কখনোই কপি বা প্রতিযোগিতার বিষয় হতে পারে না। জগন্নাথ ভক্তি সার্বজনীন হলেও প্রতিটি তীর্থস্থানের নিজস্ব মাহাত্ম্য রয়েছে। পুরীর রথযাত্রা ও দীঘার রথযাত্রা—এই দুই উৎসবই তাঁদের নিজ নিজ জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একে অপরের প্রতিযোগী নয়।
সমাধানের পথে এগোতে গেলে প্রয়োজন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা। নতুন মন্দির গড়তে গেলে অবশ্যই ইতিহাস, আবেগ ও বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে নাম ও প্রচারে সংযম থাকা দরকার। দীঘার জগন্নাথ মন্দির নতুন একটি তীর্থক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠতেই পারে, তবে তা যেন পুরীর মাহাত্ম্যকে খাটো না করে।
পুরী বনাম দীঘা—এই দ্বন্দ্ব যেন দুই রাজ্যের মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিবাদের প্রতীক হয়ে না দাঁড়ায়। বরং এটি হতে পারে এক নতুন ধর্মীয় পর্যটন মডেলের পথপ্রদর্শক, যেখানে ঐতিহ্য, আস্থার পাশাপাশি সমন্বয় ও সম্মান থাকবে অগ্রভাগে। দীঘার মন্দির হোক ভক্তির এক নতুন ঠিকানা, যেখানে পুরীর প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রেখে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা ছড়িয়ে পড়বে—এই হোক আগামীর দিশা।