যোগমায়া আচার্য ও পিয়া রায়
হাওড়ার রামরাজাতলা রাম মন্দির ঘিরে যে রাম বিসর্জনের মেলা প্রতি বছর আয়োজিত হয়, তা শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এ অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। রামনবমী উদযাপনের পরে শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবারে পালিত এই বিসর্জন উৎসবকে ঘিরে গোটা রামরাজাতলা যেন নতুন প্রাণ পায়। চারদিকে ঢাক-ঢোল, ধুনুচির ধোঁয়া, শঙ্খধ্বনি আর জয় শ্রী রামের ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে অলিগলি।
প্রথা অনুযায়ী, রামনবমীর দিন যে বিশেষ সাজসজ্জায় রাম, সীতা, লক্ষ্মণ ও হনুমানের বিগ্রহ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয়, তা পরবর্তী নয়দিন পূজা, রামায়ণ পাঠ ও কীর্তনের মধ্য দিয়ে পূজিত হয়। তারপরেই পুরো চার মাস পরে আসে সেই বহুল প্রতীক্ষিত বিসর্জনের দিন—যেখানে এই বিগ্রহগুলি এক বিরাট শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
এই বিসর্জনের দিন বসে হাওড়া জেলার অন্যতম পুরনো ও বৃহৎ মেলা। রামরাজাতলা, মহেন্দ্র ভট্টাচার্য রোড জুড়ে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হন এই উপলক্ষে। শিশুদের জন্য রকমারি খেলনার দোকান, বয়স্কদের জন্য আচার-বড়ি, চাট-ফুচকা-মিষ্টির অগণিত স্টল, আর রামভক্তদের জন্য ধর্মীয় বই ও পূজার সামগ্রীর ভ্রাম্যমাণ দোকান—সব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত লোকোৎসব। মেলায় একসময় বাউল গান, পালাগান ও কীর্তনের আসরও জমজমাট হতো, যা এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
রাম বিসর্জনের শোভাযাত্রা নিজেই এক বিশেষ আকর্ষণ। দেবতাদের সাজানো হয় রাজকীয় অলংকারে, সঙ্গে থাকে ঢাকি, ধুনুচি নৃত্যশিল্পী, ফুল ছিটানো ও জল ছিটিয়ে পবিত্র করা। রাস্তা জুড়ে জড়ো হয় হাজারো ভক্ত, জয়ধ্বনি ওঠে আকাশ ছাপিয়ে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও মন্দির কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে বিশাল পরিসরের নিরাপত্তা, ভিড় নিয়ন্ত্রণ, পানীয় জল ও স্বাস্থ্য পরিষেবা রাখা হয় যাতে উৎসব নির্বিঘ্নে হয়।
এই দিনটির একটি গভীর ধর্মীয় তাৎপর্যও রয়েছে। অনেকের বিশ্বাস, রাম বিসর্জনের দিনে রামরাজাতলার মন্দিরে উপস্থিত হলে ভগবান রামের বিশেষ কৃপা লাভ হয়। অনেকে এই দিন অন্নদান, দানপত্র বা পুণ্যস্নান করেন। বহু পরিবার এই দিনটিকে তাঁদের পারিবারিক মানতের দিন হিসেবেও পালন করেন।
রাম বিসর্জনের মেলা তাই কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়—এটি একটি ইতিহাস, একটি বিশ্বাস, একটি মিলনমেলা। রামনবমী উৎসবের এক চূড়ান্ত পরিণতি এই মেলা, যা ধর্ম, সংস্কৃতি ও লোকজ জীবনের এক অপূর্ব মিশ্রণে রূপান্তরিত হয়। এই ঐতিহ্য আজও অবিচল, উজ্জ্বল, এবং আগামী প্রজন্মের কাছে উত্তরাধিকার স্বরূপ রয়ে যাবে, ঠিক যেমন রামচন্দ্র চিরন্তন আশীর্বাদের প্রতীক হয়ে বিরাজমান এই পবিত্র রামরাজাতলায়।

