রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"নিজের অশন - বসনেও বিদ্যাসাগরের একটি অটল সরলতা ছিল। এবং সেই সরলতার মধ্যেও দৃঢ় বলের পরিচয় পাওয়া যায়। .....নিজের তিলমাত্র সম্মান রক্ষার প্রতি তাঁহার লেশমাত্র শৈথিল্য ছিল না। আমরা সাধারণত প্রবল সাহেবি অথবা প্রচুর নবাবি দেখাইয়া সম্মান লাভের চেষ্টা করিয়া থাকি। কিন্তু আড়ম্বরের চাপল্য বিদ্যাসাগরের উন্নত, কঠোর আত্মসম্মানকে কখনো স্পর্শ করিতে পারিত না। ভূষনহীন সারল্যই তাঁহার রাজভূষণ ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র যখন কলিকাতায় অধ্যয়ন করিতেন, তখন তাঁহার 'জননী দেবী চরকাসুতা কাটিয়া পুত্রদ্বয়ের বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া কলিকাতায় পাঠাইতেন' সেই মোটা কাপড় সেই মাতৃস্নেহ মন্ডিত দারিদ্র্য তিনি চিরকাল সগৌরবে সর্বাঙ্গে ধারণ করিয়াছিলেন। তাঁহার বন্ধু তদানীন্তন লেফটেন্যান্ট গভর্ণর হ্যালিডে সাহেব তাঁহাকে রাজ - সাক্ষাতের উপযুক্ত সাজ করিয়া আসিতে অনুরোধ করেন। বন্ধুর অনুরোধে বিদ্যাসাগর কেবল দুই - একদিন চোগা - চাপকান পরিয়া সাহেবের সাথে দেখা করিতে গিয়াছিলেন। কিন্তু সে লজ্জা আর সহ্য করিতে পারিলেন না। বলিলেন, ' আমাকে যদি এই বেশে আসিতে হয় তবে এখানে আর আমি আসিতে পারিব না '। হ্যালিডে তাঁহাকে তাঁহার অভ্যস্ত বেশে আসিতে অনুমতি দিলেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ( যদিও তার বাহ্যিক বেশ) যে চটি জুতা ও মোটা ধুতি চাদর পরিয়া সর্বত্র সম্মান লাভ করেন বিদ্যাসাগর রাজদ্বারেও তাহা ত্যাগ করিবার আবশ্যকতা বোধ করেন নাই। তাঁহার নিজের সমাজে যখন ইহাই ভদ্রবেশ, তখন তিনি অন্য সমাজে অন্য বেশ পরিয়া আপন সমাজের ও সেই সঙ্গে আপনার অবমাননা করিতে চাহেন নাই। সাদা ধুতি ও সাদা চাদরকে ঈশ্বরচন্দ্র যে গৌরবে অর্পণ করিয়াছিলেন, আমাদের বর্তমান রাজাদের ছদ্মবেশ পরিয়া আমরা আমরা আপনাদিগকে সে গৌরব দিতে পারি না; বরঞ্চ এই কৃতকর্মের উপর দ্বিগুণতর কৃষ্ণকলঙ্ক লেপন করি। আমাদের এই অপমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্ম গ্রহণ করিল আমরা বলিতে পারি না । "
তথ্যসূত্রঃ বিদ্যাসাগর - চরিত, রবীন্দ্র - রচনাবলী শতবার্ষিক সংস্করণ, একাদশ খন্ড, পৃষ্ঠা : ৩৪৭ - ৩৪৮
তথ্যসংগ্রহ ও সম্পাদনা: রাজীব সিকদার, কলকাতা