আর বিপ্লব
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের পতন একদিনের ঘটনা নয়, বরং এটি দীর্ঘ কয়েক দশকের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ফল। স্বাধীনতার পর একসময় কংগ্রেস ছিল রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আধিপত্য ক্ষয় হতে শুরু করে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্টের উত্থান কংগ্রেসের জন্য প্রথম বড় ধাক্কা ছিল। বামদের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনে কংগ্রেস বিরোধী দল হিসেবে থেকে ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারায়। এই সময় দলীয় ভিত ভেঙে যায়, গ্রামীণ ও শহুরে পর্যায়ে সংগঠন দুর্বল হয়, আর তৃণমূল স্তরের নেতৃত্ব অনেকাংশেই অন্য দলে চলে যায়। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে ভোটব্যাঙ্কে—যেখানে একসময় কংগ্রেস ছিল প্রভাবশালী, সেখানে বাম ও পরে তৃণমূলের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস গঠন কংগ্রেসের জন্য দ্বিতীয় বড় ধাক্কা নিয়ে আসে। মমতা বামবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেন এবং দ্রুত সাধারণ মানুষের সমর্থন কুড়িয়ে নেন। কংগ্রেস বামবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়, ফলে যে ভোট আগে স্বাভাবিকভাবে কংগ্রেসের ঝুলিতে যেত, তা সরাসরি তৃণমূলের দিকে চলে যায়। এর ফলে কংগ্রেসের অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই সময়ে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও রাজ্য রাজনীতিতে তেমন মনোযোগ দেয়নি। রাজ্যে নেতৃত্ব বারবার বদলেছে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি হয়নি। স্থায়ী, শক্তিশালী এবং ক্যারিশমাটিক রাজ্য নেতৃত্বের অভাবে দল কর্মী ও ভোটার—দুই স্তরেই আস্থা হারাতে থাকে। বামফ্রন্ট বিরোধিতায় কংগ্রেস ও তৃণমূলের একসময়ের মিত্রতা শেষমেশ রাজনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়, কারণ তৃণমূল নিজের সাংগঠনিক বিস্তার ঘটিয়ে কংগ্রেসের অনেক নেতাকর্মীকে টেনে নেয়।
তৃণমূলের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতির প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, আগ্রাসী জনসংযোগ এবং সাংগঠনিক দক্ষতা কংগ্রেসকে ক্রমেই কোণঠাসা করে দেয়। সাধারণ মানুষের চোখে বামবিরোধী প্রধান শক্তি হয়ে ওঠে তৃণমূল, আর কংগ্রেস হয়ে পড়ে প্রান্তিক দল।
২০১৪ সালের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। বিজেপি, কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল হিসেবে, পশ্চিমবঙ্গে দ্রুত বিস্তার ঘটায়। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহলের মতো অঞ্চলে তারা প্রভাব বাড়াতে থাকে। এতে বিরোধী ভোট দুইভাগ হয়ে যায়—একটি অংশ তৃণমূলের বিপক্ষে গিয়ে বিজেপিকে সমর্থন করে, আরেকটি অংশ তৃণমূলের পক্ষে থাকে। কংগ্রেস এই দুই মেরুকরণের মাঝে কার্যত হারিয়ে যায়।
সময়ের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে কংগ্রেসের ঐতিহাসিক ভূমিকা অস্পষ্ট হয়ে যায়। স্বাধীনতার সময় বা প্রাথমিক দশকের সাফল্যের স্মৃতি তাদের কাছে অতীত ইতিহাসের অংশ, যা তাদের বর্তমান রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে না। বরং তারা বর্তমানের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তৃণমূল ও বিজেপিকেই দেখে। এই প্রাসঙ্গিকতা হারানোই কংগ্রেসের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর ওপর কংগ্রেসের জোটনীতি ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। কখনো বামফ্রন্টের সঙ্গে, কখনো তৃণমূলের সঙ্গে—এই অনিশ্চিত অবস্থান দলকে অবিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। ভোটাররা স্পষ্ট অবস্থান চায়, কিন্তু কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে যারা বিকল্প খুঁজছিল, তারা তৃণমূল বা বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে।
সব মিলিয়ে, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের
পতনের মূল কারণ কয়েকটি ধারায় স্পষ্ট—
এক, নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার অভাব এবং রাজ্য নেতৃত্বের দুর্বলতা।দু
ই, তৃণমূল স্তরে সংগঠন ভাঙন এবং কর্মীপ্রবাহ অন্য দলে চলে যাওয়া।
তিন, বামবিরোধী আন্দোলনে শক্তিশালী বিকল্প হতে
না পারা।
চার, তৃণমূল ও বিজেপির দ্বিমুখী লড়াইয়ে নিজের
অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়া।
পাঁচ, ভোটার মনস্তত্ত্বে আস্থা ও প্রাসঙ্গিকতা
হারানো।

