পিয়া রায়
ভারতের অন্যতম মহাতীর্থ পুরীধামের জগন্নাথদেব শুধু ওড়িশার আধ্যাত্মিক পরিচয়ের কেন্দ্র নন, সমগ্র ভারতবর্ষের এক অনন্য দেবত্বের প্রতীক। এই দেবমূর্তির বৈশিষ্ট্য যে অদ্বিতীয়, তা যে কেউ চোখের সামনে দেখলেই বুঝতে পারে। ভিন্নধর্মী এই রূপের উৎপত্তি নিয়ে একটি প্রাচীন ও জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে, যেখানে বলা হয়—জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের মূর্তির প্রথম রূপদান করেছিলেন স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা।
প্রচলিত আখ্যান অনুযায়ী, মালবা রাজ্যের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এক রাতে স্বপ্নে ভগবান বিষ্ণুর দর্শন পান। বিষ্ণু তাঁকে নির্দেশ দেন যে তিনি পুরীতে এসে নীলমাধব দেবতার পূজা প্রতিষ্ঠা করুন। রাজা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নীলমাধবকে পাননি। অবশেষে দেবদেবীর কৃপায় তাঁকে জানানো হয়, ভগবান নিজেই এক বিশেষ রূপে প্রকাশিত হবেন। রাজা তখন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে আহ্বান করেন মূর্তি নির্মাণের জন্য।
বিশ্বকর্মা রাজাকে শর্ত দেন—যতদিন পর্যন্ত দেবমূর্তি সম্পূর্ণ না হয়, ততদিন যেন কেউ তাঁর কর্মশালায় প্রবেশ না করে। দীর্ঘ সময় ধরে দরজা বন্ধ থাকায় রাজা ও প্রজারা অধীর হয়ে ওঠেন। অবশেষে ধৈর্য হারিয়ে রাজা দরজা খুলে দেন। তখন দেখা যায়, বিশ্বকর্মা অদৃশ্য হয়ে গেছেন, আর অসমাপ্ত অবস্থায় তিনটি মূর্তি বিরাজ করছে—জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার। এই মূর্তিগুলোর হাত-পা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, চোখ বড় ও অদ্ভুত রূপে স্থাপিত হয়। কিন্তু রাজা বুঝতে পারেন, এটাই ভগবানের ইচ্ছা। দেবমূর্তিগুলোকে সেই অবস্থাতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা আজও সমানভাবে পূজিত হয়ে আসছে।
এই কাহিনি থেকে বোঝা যায়, পুরীর জগন্নাথদেবের রূপ আসলে ঐশ্বরিক ইচ্ছার প্রতিফলন, মানুষের কারিগরি দক্ষতার সীমাবদ্ধতা নয়। ভক্তজন বিশ্বাস করেন, বিশ্বকর্মার অসমাপ্ত কাজই আসলে দেবতার চূড়ান্ত রূপ, যা মানুষের বোধগম্যের বাইরে। পুরাণে বলা হয়েছে, ভগবান নিজেই এমন রূপ ধারণ করেছেন যাতে ভক্তরা তাঁকে সরলভাবে গ্রহণ করতে পারেন।
তবে উল্লেখ্য, এই কাহিনি ইতিহাসের প্রমাণসাপেক্ষ দলিল নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক গবেষণা এ বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য দেয় না। এটি মূলত এক জনপ্রিয় ভক্তিমূলক বিশ্বাস, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুরীধামে রথযাত্রা ও মন্দির সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। তবু ভক্তদের কাছে এই কাহিনি শুধু একটি কিংবদন্তি নয়, বরং ভগবানের ইচ্ছার প্রকাশ।
অতএব, বলা যায়—“জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের প্রথম রূপদান বিশ্বকর্মা করেছিলেন”—এটি একটি বহুল প্রচলিত পৌরাণিক আখ্যান, যা সঠিক ও নির্ভুলভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে গৃহীত। ইতিহাসের বিচারে তা প্রমাণিত না হলেও, ভক্তদের মনে এটি সর্বতোভাবে সত্য।


