রাজীব সিকদার
কংগ্রেসের সত্য মিথ্যা মেশানো চিন্তায় লেবুর রস ছিটিয়ে দিয়ে গেলেন শরৎচন্দ্র। তাই নিয়েই তো গান্ধীপন্থীদের শরৎচন্দ্রের উপর এতো বিরোধ। আবার গান্ধীর মুখের উপর উত্তর। জাতপাত,ধর্ম বর্ণ রাজনীতি নির্বিশেষে সব মানুষের সাথে মেলামেশা, রাত করে বাড়ি ফেরা। আবার ভবানীপুরে মেয়েদেরকে অফিসে এনে নারী মুক্তি কেন্দ্র খোলা। গান্ধীর চরকা আন্দোলনের সমালোচনা। শরৎচন্দ্রের এই সব আচরণ গান্ধীপন্থী ও দলের বংশবদ বেঙ্গল লবির কাছে খামখেয়ালীপনা ও উত্তেজনাকর।এসব সহ্য হয়নি রক্ষনশীল কংগ্রেসপন্থীদের। এই সব কিছুই শরৎবাবুকে বাধ্য করেছিলেন রাজনীতি থেকে দূরে সরে যেতে।
দেশবন্ধু, সুভাষ বোস সেই সময় আঞ্চলিক স্তরের নেতৃত্ব, খানিকটা কোন ঠাসা। স্বভাবতই প্রকাশ্যে শরৎ বাবুকে সমর্থন করা দুঃসাধ্য । তারা যোগাযোগ রাখলেন নেপথ্যে। শরৎ বাবুকে আর প্রকাশ্যে রাজনীতিতে রেখে তাঁরাও কথা বলার সাহস পেলো না। পরবর্তী সারা জীবন শরৎচন্দ্র দেশমুক্তির বা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খবর নিতেন চোখের জল ফেলতে ফেলতে। কুৎসিত রাজনীতিতে আর ফেরেননি।
কিন্তু, এত কিছুর পরেও সহযোগিতা করতে ভোলেননি। নিজেকে শেষ করেছেন তিলে তিলে। দেশবন্ধু চলে যাওয়ার পর আর কারো কাছে সাহায্য চাননি। জুটিয়ে ছিলেন কোম্পানির কাজ, করেছেন চায়ের দোকান আর কখনো কখনো পত্রিকা থেকে পেতেন যৎসামান্য । তাই দিয়েই দিন গুজরান। কিন্তু সত্য বলতে ছাড়েন নি। আবার কাউকে আঘাত দেন নি। শুধু লেখনীতে উল্লেখ করে গেছেন চিন্তার বেড়াজাল কিম্বা সীমাবদ্ধতাগুলো।
কিন্তু শেষ বিচারে কংগ্রেস তাকে রাজনীতি ছাড়াতে পারেনি। করে গেলেন কলমের রাজনীতি যা ব্রিটিশদের বুকেও কাঁপন ধরিয়েছিল। অশেষ জীবন যন্ত্রণার মধ্যেই নিজ কলমে সৃষ্ট 'পথের দাবীকে' পথেই রেখে দিলেন শরৎবাবু। একে একে রাজনীতির সব উত্তরগুলো দিলেন। দেখালেন বিপ্লবী চরিত্রের নানান স্তর আর সব্যসাচী সৃষ্টি করে সর্বোত্তম রাজনীতির রূপ ও স্বাদ। একটা চরিত্রও মনগড়া বা গতানুগতিক কাল্পনিক নয়। সবই ভারতীয় বিপ্লববাদের বাস্তব জমি থেকে নেওয়া। শুধুমাত্র চরিত্রের নামকরণের ক্ষেত্রে তিনি নিজ মতকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
১৯২৬ এ পথের দাবী প্রকাশের পরেই পরেই ভারতবর্ষ দেখলো আপোষহীন বিপ্লবী লড়াই কাকে বলে। ধরলেন গোটা রাজনীতিটাকেই। বিবেকানন্দ বা অরবিন্দের অধ্যাত্মবাদ বা গীতার ভাবধারা থেকে বেরোনো বা বিপ্লবীদের বার করার লড়াই। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৮ এই বছরগুলিতে একদিকে গণ আন্দোলন আরেকদিকে কুখ্যাত ব্রিটিশ শাসকদের উপর থামানোর পরিকল্পনা শুরু হলো । অন্যদিকে, গান্ধীপন্থীদের সাথে সুভাষ বোসের মুখোমুখী গণতান্ত্রিক রাজনীতির লড়াই নীতিগত জয় পেলো। গান্ধীপন্থীদের বিকল্প রাজনীতি দেখলো ভারতবর্ষ। সফলতা পেলো পথের দাবী।
এদিকে ১৯৩৩-১৯৩৪ সাল নাগাদ ঢাকা সংলগ্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্লাস সেভেনের ছাত্র শিবদাস ঘোষের হাতে পথের দাবী তুলেন দিলেন ঢাকা অনুশীলন সমিতির আরেক বিপ্লবী নীহার মুখার্জী। দুজনের সাক্ষাৎ শুরু এখান থেকেই । এরপর রাজনীতির নানান ঘাত প্রতিঘাতে চলতে চলতে এসেছে বছরগুলি।
১৯৪০ সালে ঢাকায় সুভাষ বোসের সভায় দুজনই স্বেচ্ছাসেবক। পরবর্তীতে তাঁদের ভারতে আগমন, জেল যাত্রা। জেলের ভেতরে বসেই যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পরিকল্পনা। ১৯৪৮ সালের ২৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠা করলেন এস ইউ সি আই দল। পরে ভারতে রাজনীতিতে তাঁদের পথ ধরে আবার গুরুত্ব পেলেন শরৎ বাবু। তারপর থেকে ভারতের বুকে এই শরৎচর্চাকে বিশেষত আপোষহীন বিপ্লববাদ ও পার্থিব মানবতাবাদের চর্চাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁরা নিয়েছিলেন। তার ধারা আজও অব্যাহত। আজও ভারতবর্ষে সেই পথের দাবীকে পথে রেখে আপোষহীন গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের নুতন নুতন ক্ষেত্র রচনা হচ্ছে। ভারতীয় জনগণ তারই সাক্ষী।

