পিয়া রায়
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে দুর্গাপুজো এমন এক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসব, যা প্রবাসী বাঙালির পরিচয়ের গভীরে প্রোথিত এবং ভারতীয় প্রবাসী সম্প্রদায়ের বহুমাত্রিক ঐতিহ্যের অংশ। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শেষভাগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে বিপুলসংখ্যক ভারতীয়, বিশেষত উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের মানুষ এই দ্বীপরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। তাঁদের সঙ্গে আসা সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচার এখানে গেঁথে যায়, যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে আগত বাঙালিরা দুর্গাপুজোর প্রথা প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও সংখ্যার বিচারে প্রবাসী বাঙালি জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে ছোট, তবু তাঁদের সাংস্কৃতিক প্রভাব সুস্পষ্ট, বিশেষত এই উৎসবের মাধ্যমে।
ত্রিনিদাদে দুর্গাপুজো মূলত রাজধানী পোর্ট অব স্পেন, সান ফার্নান্দো ও চাগুয়ানাস অঞ্চলে বেশি আয়োজন হয়, যেখানে প্রবাসী বাঙালিরা বসবাস করেন বা কর্মসূত্রে যুক্ত আছেন। স্থানীয় বাঙালি সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ধর্মীয় পরিষদ এ আয়োজনের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিনই পূজা অনুষ্ঠিত হয়, চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলি, ধুনুচি নাচ এবং সন্ধ্যার আরতিতে পূর্ণ হয় আবহ। প্রতিমা অনেক সময় স্থানীয় শিল্পীরা মাটি ও কাঠ দিয়ে তৈরি করেন, তবে ভারত বা উত্তর আমেরিকা থেকেও আনা হয় বিশেষভাবে নির্মিত প্রতিমা, যাতে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি শৈলী বজায় থাকে।
পূজামণ্ডপ সাধারণত কমিউনিটি সেন্টার, স্কুল হল কিংবা মন্দির প্রাঙ্গণে সাজানো হয়। আলপনা, ফুল, রঙিন কাপড় ও আলোকসজ্জায় এই স্থানগুলো এক টুকরো বাঙালিয়ানা পরিবেশে রূপ নেয়। ঢাক ও কাঁসরের ধ্বনি, পাশাপাশি স্থানীয় ক্যালিপসো সুরের অনন্য মিশ্রণ এক ভিন্নতর উৎসব রসায়ন তৈরি করে, যা ত্রিনিদাদের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক চরিত্রের প্রতিচ্ছবি।
ভোগ পরিবেশনে থাকে খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি, পায়েসসহ প্রথাগত বাঙালি পদ, যা প্রবাসী রাঁধুনিদের হাতে নতুন স্বাদ পায়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত শাকসবজি, উষ্ণমণ্ডলীয় ফল এবং মশলা রান্নায় ব্যবহৃত হয়, ফলে ভোগে মিশে যায় ত্রিনিদাদের নিজস্ব খাদ্যঐতিহ্য। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, আধুনিক বাংলা গান, নাটক, কবিতা ও নৃত্যানুষ্ঠান, যেখানে প্রবাসী শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রবীণরা সক্রিয় অংশ নেন।
দশমীর দিন সিঁদুর খেলা এক বিশেষ আবেগময় মুহূর্ত। বিসর্জনের জন্য স্থানীয় নদী বা সমুদ্রসৈকত বেছে নেওয়া হয়, তবে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিমা প্রতীকীভাবে বিসর্জন দিয়ে পুনঃব্যবহার করা হয় পরিবেশগত সচেতনতার কারণে। এ আয়োজনে প্রায়শই ভারতীয় বংশোদ্ভূত অন্যান্য সম্প্রদায়, এমনকি আফ্রো-ত্রিনিদাডিয়ানরাও অংশ নেন, যা দ্বীপরাষ্ট্রের বহুজাতি ও বহুধর্মীয় সম্প্রীতির নিদর্শন।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর দুর্গাপুজো শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং প্রবাসী বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এখানে পূজার মণ্ডপে মিলিত হয় আটলান্টিকের তটরেখা, বঙ্গোপসাগরের স্মৃতি আর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মিলনধারা। প্রবাসের ব্যস্ততার মাঝেও এই উৎসব প্রতি বছর বাঙালিদের মনে করিয়ে দেয়, তাঁরা যত দূরেই থাকুন না কেন, দুর্গাপুজো তাঁদের শিকড়ের সঙ্গে এক অটুট বন্ধন বজায় রাখে।
ছবি: সংগৃহীত