আর বিপ্লব
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বর্তমানে চারটি প্রধান শক্তিকে ঘিরে আবর্তিত—তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি, বামফ্রন্ট তথা সিপিআইএম, এবং কংগ্রেস। প্রত্যেকেরই একটি ঐতিহাসিক পটভূমি, আলাদা আদর্শিক অবস্থান, এবং নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক আছে। কিন্তু একই সঙ্গে আছে নেতিবাচক দিক, ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা, যা জনগণের আস্থা ও রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণে প্রভাব ফেলছে। বর্তমান সময়ে রাজ্যের মানুষ এই চার দলকে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করছে, আর সেই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের রূপরেখা।
তৃণমূল কংগ্রেস, ২০১১ সালে বামফ্রন্টকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসার সময় মানুষের কাছে ছিল পরিবর্তনের প্রতীক। প্রথম পাঁচ বছরে কিছু সামাজিক প্রকল্প, মহিলাদের জন্য কন্যাশ্রী, ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছাত্রঋণ বা সাইকেল প্রকল্প—এসব জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হয়ে দাঁড়ায় দুর্নীতি ও স্বজনপোষণ। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, কয়লা ও গরু পাচার কেলেঙ্কারি, তৃণমূলের স্থানীয় স্তরের “কাটমানি” সংস্কৃতি—এসব মানুষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি করেছে। তাছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগও কম নয়; গ্রামীণ পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে শুরু করে বিধানসভা ভোট—সব জায়গাতেই বিরোধীদের উপর দমননীতি অভিযোগে দলটি সমালোচিত। ফলে তৃণমূল যদিও এখনও রাজ্যের সবচেয়ে বড় দল, তবে অনেক ভোটার মনে করছেন দলটি ক্ষমতার দম্ভে জনসংযোগ হারিয়েছে। তারা বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে, যদিও সেই বিকল্পকে বিশ্বাস করার মতো আস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি।
বিজেপি, সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হলেও, তার নিজস্ব কিছু জটিলতা আছে। উত্তর ভারতকেন্দ্রিক ভাবমূর্তি, সাংগঠনিক নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ বিভাজন, এবং অতিরিক্ত ধর্মীয় মেরুকরণ—এসব মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করেছে। অনেক ভোটার মনে করেন বিজেপির জাতীয় নীতি বাংলার সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয়ের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খায় না। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ও NRC নিয়ে অনিশ্চয়তা সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করেছে, যা সরাসরি বিজেপির বিরোধিতা বাড়িয়েছে। এমনকি হিন্দু ভোটারদের মধ্যেও কিছু অংশ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক রাজনীতি চায়, যেখানে বিজেপি ধর্মীয় ইস্যুকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ায় বিরক্তি তৈরি হচ্ছে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক নীতি—বেকারত্ব বৃদ্ধি, পেট্রোল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধি, কৃষি আইন নিয়ে বিতর্ক—এসবও বিজেপির ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাই অনেকে তৃণমূলকে শাস্তি দিতে চাইলে বিজেপিকে বিকল্প হিসেবে ভাবলেও, চূড়ান্ত আস্থা রাখতে দ্বিধাগ্রস্ত।
বামফ্রন্ট তথা সিপিআইএম, একসময় রাজ্যের স্থায়ী শাসক শক্তি ছিল, কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে ক্রমশ রাজনৈতিক প্রান্তিকতায় চলে গেছে। ৩৪ বছরের শাসনকাল শেষে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মানুষের প্রধান অভিযোগ ছিল প্রশাসনিক স্থবিরতা, শিল্পবিরোধী মনোভাব, এবং কর্মসংস্থানের সংকট। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের মতো শিল্পায়ন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত সিদ্ধান্ত রাজ্যের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, আর সেই ক্ষোভই তৃণমূলের উত্থান ঘটিয়েছে। বর্তমানে বামফ্রন্টের সবচেয়ে বড় সমস্যা সংগঠনের ভেঙে পড়া কাঠামো এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আকর্ষণ হারানো। অনেক ভোটার বামফ্রন্টের আদর্শিক অবস্থানকে সম্মান করলেও মনে করেন, দলটি বাস্তবসম্মত ক্ষমতায় ফেরার মতো শক্তি অর্জন করতে পারবে না। ফলে তারা বামফ্রন্টকে অনেক সময় “প্রতীকী ভোট” দেন, কিন্তু রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার মতো প্রস্তুতি কম মনে করেন।
কংগ্রেস, বাংলায় স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক দশক শক্তিশালী দল হলেও, বর্তমানে তার অস্তিত্ব প্রায় সীমিত কয়েকটি অঞ্চলে। সংগঠনের ভাঙন, নেতৃত্বের সংকট, এবং জাতীয় রাজনীতিতে দলের দুর্বল অবস্থান—এসব মিলিয়ে কংগ্রেসকে রাজ্যে কার্যকর বিকল্প হিসেবে দেখা হয় না। দলের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, গ্রামীণ স্তরে সাংগঠনিক অনুপস্থিতি, এবং নির্দিষ্ট নীতি বা ভিশনের অভাব—এসব ভোটারদের আস্থা কমিয়েছে। অনেকেই মনে করেন, কংগ্রেস এখন আর রাজ্য রাজনীতিতে স্বাধীন শক্তি নয়, বরং অন্য বিরোধী শক্তির সঙ্গে জোটে টিকে থাকা দল।
এই চারটি দলের নেতিবাচক দিক মিলিয়ে রাজ্যের মানুষ এখন এমন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, যেখানে “কাকে ভোট দেব” প্রশ্নের চেয়ে “কাকে ভোট দেব না” প্রশ্নটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সহিংসতার ক্ষোভ, বিজেপির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও নীতিগত অবিশ্বাস, বামফ্রন্টের সংগঠনগত দুর্বলতা, এবং কংগ্রেসের প্রাসঙ্গিকতা হারানো—সবই ভোটারদের দ্বিধায় ফেলছে।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ স্পষ্টভাবে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং রাজনৈতিক সহিংসতার অবসান চায়। তারা এমন এক নেতৃত্বের খোঁজ করছে, যা একদিকে রাজ্যের ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা করবে, অন্যদিকে বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে কাজের সুযোগ, স্টার্টআপে সহায়তা, এবং আধুনিক অবকাঠামো উন্নয়নের দাবি করছে। গ্রামীণ ভোটাররা কৃষিতে স্থায়ী বিনিয়োগ, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, এবং বাজারে ন্যায্য মূল্য নিশ্চয়তা চায়।
ভবিষ্যতে ভোটারদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে কোন দল এই প্রত্যাশাগুলি পূরণের বিশ্বাসযোগ্য রূপরেখা দিতে পারে তার উপর। তৃণমূল যদি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে এবং স্বচ্ছ প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় বাস্তব পদক্ষেপ নেয়, তবে তার শক্তিশালী সংগঠন ভর করে আবারও আস্থা ফেরাতে পারে। বিজেপি যদি ধর্মীয় মেরুকরণের বাইরে এসে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দেয় এবং আঞ্চলিক পরিচয়ের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারে, তবে বিকল্প হিসেবে আরও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। বামফ্রন্ট যদি তরুণ প্রজন্মকে সংগঠনে টানে এবং আধুনিক অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে পুনরুত্থানের সম্ভাবনা আছে। কংগ্রেসকে হলে নতুন নেতৃত্ব, স্পষ্ট নীতি, এবং তৃণমূল-বিজেপি-বাম এই ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে স্বাধীন শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে।
তবে রাজনীতির বাস্তবতায় এই পরিবর্তনগুলি কতটা ঘটবে, তা অনিশ্চিত। জনগণের প্রত্যাশা এখন শুধু পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি শোনায় সীমাবদ্ধ নয়; তারা ফল দেখতে চায়। অতীতের অভিজ্ঞতা তাদের শিখিয়েছে যে, ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতা ধরে রাখার মধ্যে বিশাল পার্থক্য আছে। তাই আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হয়তো কম আবেগপ্রবণ, বেশি হিসাবি ভোটার হয়ে উঠবে—যেখানে দলীয় আনুগত্যের চেয়ে বাস্তব ফলাফলই হবে সিদ্ধান্তের মাপকাঠি।