নরেন্দ্রনাথ কুলে
'...হঠাৎ চমকে উঠে শুনি, আবার যুদ্ধ-- বাজনা বাজছে--এ যুদ্ধবাদ্য বহু পশ্চাতের । দেখি তালে তালে পা ফেলে আসছে---সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিস্ট সেনা ।' নজরুলের এ কথার ছবি আজকে দেখা যাচ্ছে না, তা একেবারেই বলা যায় কি ? এ প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে নজরুলের কথা উল্লেখ করা যায় । কবি বলছেন--গত মহাযুদ্ধের ঢেউ আরব সাগরের তীর অতিক্রম করেনি, কিন্তু এবারকার এই আইডিয়া জগতের মহাযুদ্ধ বিশ্বের সকল দেশের সবখানে শুরু হয়ে গেছে । দশ মুন্ড দিয়ে খেয়ে, বিশ হাত দিয়ে লুন্ঠন করেও যার প্রবৃত্তির আর নিবৃত্তি হ'ল না সেই পুঁজিবাদী রাবণ ও তার বুর্জোয় রক্ষ-সেনারা এদের বলে হনুমান ।..আজকের বিশ্ব-সাহিত্যে এই হনুমানও লাফাচ্ছে এবং সাথে সাথে স্বর্ণ লঙ্কাও পুড়ছে -- এ আপনারা যে-কেউ দিব্যচক্ষে দেখছেন বোধ হয় । না দেখতে পেলে চশমাটা একটু পরিষ্কার করে নিলেই দেখতে পাবেন । দূরবীণের দরকার হবে না ।
'...হঠাৎ চমকে উঠে শুনি, আবার যুদ্ধ-- বাজনা বাজছে--এ যুদ্ধবাদ্য বহু পশ্চাতের । দেখি তালে তালে পা ফেলে আসছে---সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিস্ট সেনা ।' নজরুলের এ কথার ছবি আজকে দেখা যাচ্ছে না, তা একেবারেই বলা যায় কি ? এ প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে নজরুলের কথা উল্লেখ করা যায় । কবি বলছেন--গত মহাযুদ্ধের ঢেউ আরব সাগরের তীর অতিক্রম করেনি, কিন্তু এবারকার এই আইডিয়া জগতের মহাযুদ্ধ বিশ্বের সকল দেশের সবখানে শুরু হয়ে গেছে । দশ মুন্ড দিয়ে খেয়ে, বিশ হাত দিয়ে লুন্ঠন করেও যার প্রবৃত্তির আর নিবৃত্তি হ'ল না সেই পুঁজিবাদী রাবণ ও তার বুর্জোয় রক্ষ-সেনারা এদের বলে হনুমান ।..আজকের বিশ্ব-সাহিত্যে এই হনুমানও লাফাচ্ছে এবং সাথে সাথে স্বর্ণ লঙ্কাও পুড়ছে -- এ আপনারা যে-কেউ দিব্যচক্ষে দেখছেন বোধ হয় । না দেখতে পেলে চশমাটা একটু পরিষ্কার করে নিলেই দেখতে পাবেন । দূরবীণের দরকার হবে না ।
এই সময়ে লুন্ঠনের চরিত্র আজ অনেকটা বদলে গেছে । তবু তার অন্তরের কাঠামোর কোন বদল হয়েছে তা কিন্তু নয় । কবির কথায় তার প্রতিধ্বনি সর্বোত্র--যারা যত বড় ডাকাত দস্যু জোচ্চোর দাগাবাজ/তারা তত বড় সম্মানী গুণী জাতি-সঙ্ঘেতে আজ । এই দাগাবাজদের শয়তানির কথা উল্লেখ করে কবি বলেছেন মানবের ধ্বংসের কথা । তিনি বলছেন, 'পেতেছে বিশ্বে বণিক বৈশ্য অর্থ বেশ্যা,/নাচে সেটা পাপ-শয়তান-সাকী, গাহে যক্ষের জয় ।/অন্ন, স্বাস্থ্য, প্রাণ, আশা, ভাষা হারায়ে সকল কিছু,/দেউলিয়া হয়ে চলেছে মানব ধ্বংসের পিছু পিছু ।/পালাবার পথ নাই,/দিকে দিকে আজ অর্থ পিশাচ খুঁড়িয়াছে গড়খাই ।' সব হারিয়ে মানুষ যখন দিশেহারা তখন দাগাবাজদের আর এক শয়তানির কথা কবি বলেছেন--জাতিতে জাতিকে ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ এরা আনি/আপনার পেট ভরায়, তখ্ত চায় এরা শয়তানী ।'
কবির কথাগুলো কি আজকে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে ? এ প্রশ্নে তাঁর কথাই স্পষ্ট করে দেয় আজও----'..আমি যা বলেছি, যা লিখেছি তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয়, ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয় । কিন্তু হয়তো সে শাস্তি দেবে । কেননা সে সত্যের নয়, সে রাজার । সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের । সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য । তবু জিজ্ঞাসা করছি এই যে বিচারাসন---এ কার ? রাজার না ধর্মের ?...অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে হবে রাজদ্রোহ । এতো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না, এই যে জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো--একি সত্য সহ্য করতে পারে ?' সত্য সহ্য করতে পারে না বলেই সত্যকে হত্যা করাই ওদের কাজ বলে কবি দেখিয়ে দিয়ে বলেন, '..জালিম ওরা অত্যাচারী ।/ সার জেনেছে সত্য যাহা হত্যা তারই ।/জালিম ওরা অত্যাচারী ।'
কবি শুধু তাঁর কথা দিয়ে বা লেখনী দিয়ে ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয় । তাঁর কর্মজীবনে প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন । ন্যায়ের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন । লেখক, কবি, সাংবাদিক জীবনে তাঁর আপোষহীন প্রতিবাদ আজকের সময়কে ব্যঙ্গ না করে পারে না ।
'..হিন্দু-মুসলমান দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনের একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋণ, অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা স্তুপের মত জমা হয়ে আছে, এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম । আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম ..।' তাঁর জীবন-কথার স্পষ্টতা আমাদের চোখের চশমাটা সত্যি পরিষ্কার করে আজ দেখতে হবে !