আর বিপ্লব
আন্তর্জাতিক কূটনীতির পটভূমিতে সাম্প্রতিক সময়ে দুটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর সংঘাত—ভারত-পাকিস্তান এবং ইরান-ইজরায়েল—বিশ্বের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে নড়বড়ে করে তুলেছে। এই দুই সংঘাতেই একটি সাধারণ চরিত্র হঠাৎই দৃশ্যমান—সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘শান্তি স্থাপনে আগ্রহ’। প্রশ্ন হচ্ছে, এই আগ্রহ কি নিছক বিশ্বশান্তির পক্ষে এক উদার আমেরিকান হস্তক্ষেপ? নাকি এর আড়ালে রয়েছে এক সুপরিকল্পিত ব্যক্তিগত কৌশল—নোবেল শান্তি পুরস্কারের দিকে যাত্রা?
কয়েকটি তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে অনায়াসে বোঝা যায় কিভাবে ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় দফার রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারকে একটি ‘ট্রফি টার্গেট’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এবং সেই লক্ষ্যেই তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংঘাতে যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতায় নিজেকে জড়াতে শুরু করেছেন।
ট্রাম্পের অতীত কূটনৈতিক মধ্যস্থতা: একটি প্যাটার্ন
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেই আমরা তার ‘নোবেল কূটনীতি’র ছায়া দেখতে পাই। ২০২০ সালে ইসরায়েল ও আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান এবং মরক্কোর মধ্যে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তি—‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’—ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যতম কূটনৈতিক সফলতা হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই সময়ই তিনি দাবি করেন, তিনি ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য’। যদিও তাঁর নাম মনোনয়ন তালিকায় থাকলেও, পুরস্কারটি তিনি পাননি।
এই প্যাটার্নটি ২০২৪-এর মার্কিন নির্বাচনে জয়ের পর আবার ফিরে এসেছে। এবার তিনি বিশ্বের দুটি উত্তপ্ত যুদ্ধক্ষেত্রে—ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত এবং ইরান-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব—নতুনভাবে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছেন।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সম্ভাবনায় ট্রাম্পের আগ্রহ
কাশ্মীর ইস্যু, সীমান্ত সংঘর্ষ, এবং সন্ত্রাসবাদ—ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের পুরনো চালচিত্র। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক একেবারে তলানিতে পৌঁছায়। সেই সময় ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেন, তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে চান। যদিও ভারত সরকার দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে, তথাপি ট্রাম্প বারবার ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করতে থাকেন।
২০২৫ সালে দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে পুনরায় উত্তেজনা তৈরি হতেই ট্রাম্প আবার সোচ্চার হয়ে বলেন, “আমি চাই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক, আমি এতে সাহায্য করতে প্রস্তুত।” এই বক্তব্য শান্তি প্রস্তাবের চেয়ে অনেক বেশি ছিল আত্মপ্রচারমূলক। ট্রাম্পের মিডিয়া কৌশলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এই ‘শান্তির দূত’ ইমেজ।
ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ
ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ সম্ভাবনা নতুন নয়, তবে ২০২4 সালের শেষে গাজা ও লেবানন হয়ে ইরানের পরোক্ষ হস্তক্ষেপে ইজরায়েল সরাসরি পাল্টা জবাব দিতে শুরু করলে, বিষয়টি রূপ নেয় সরাসরি যুদ্ধের দিকে।
ট্রাম্প এখানে একটি চমকপ্রদ পদক্ষেপ নেন—তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দাবি করেন, “ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ নয়, আলোচনার পথ খোলা রাখা উচিত এবং আমিই সেই সেতু নির্মাণে পারদর্শী।” এই বক্তব্য মূলত বিশ্বদৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দেওয়া হয় এবং নিজেকে শান্তিপ্রিয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল স্পষ্ট।
ট্রাম্পের কৌশলগত ‘নোবেল’ লক্ষ্য
যদি আমরা ট্রাম্পের রাজনৈতিক গতিবিধি বিশ্লেষণ করি, দেখা যায়, তিনি সবসময় নিজের ব্র্যান্ড গঠনের দিকে নজর দেন—এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার একটি চূড়ান্ত অর্জন হিসেবে তাঁর কাছে ধরা পড়ে।
একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “বারাক ওবামা কিছু না করেই শান্তির নোবেল পেলেন। আমি তো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনলাম, তা সত্ত্বেও কিছুই পেলাম না।” এ থেকেই বোঝা যায়, এই পুরস্কার তার এক ব্যক্তিগত অহমের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বের যেকোনো যুদ্ধবিরতিতে ট্রাম্পের মধ্যস্থতা এখন তাই নিজের ভাবমূর্তি নির্মাণের অস্ত্র।
যুদ্ধবিরতিতে হস্তক্ষেপ নাকি মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি?
ট্রাম্পের মধ্যস্থতা প্রচেষ্টা মূলত তিনটি উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে গঠিত:
মিডিয়া দখল: ট্রাম্প জানেন আন্তর্জাতিক শান্তি আলোচনায় নাম এলেই তার উপস্থিতি মিডিয়ায় নিশ্চিত হবে।
নেতৃত্বের ইমেজ: প্রেসিডেন্ট না হয়েও নিজেকে একজন বৈশ্বিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন।
নোবেল শান্তি পুরস্কার: ব্যক্তিগত গৌরব ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ফায়দা লাভের উদ্দেশ্যে এই পুরস্কার তাঁর মূল টার্গেট।
অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে তুলনা: ট্রাম্প কতটা বাস্তববাদী?
বর্তমানে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য যারা বিবেচনায় রয়েছেন, তারা মূলত জলবায়ু আন্দোলন, ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি বা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি বা সংস্থা। ট্রাম্প সেখানে যুদ্ধ-প্রবণ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে একটি বিতর্কিত চরিত্র।
তবুও তিনি জানেন, বিশ্বে যদি কোনো বড় সংঘাতে তাঁর মধ্যস্থতায় যুদ্ধ থেমে যায়, তবে তা বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে পুরস্কার কমিটির উপর। আর ঠিক এই কারণেই তিনি এখন পুঁজিবাদী প্রোপাগান্ডার মতো 'শান্তি' বিক্রি করছেন।
যুদ্ধবিরতির প্রকৃত হালচাল: ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ কতটা কার্যকর?
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক শান্তি আলোচনা হয়নি, যেখানে ট্রাম্প সক্রিয়ভাবে যুক্ত। তেমনি ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষেও তাঁর হস্তক্ষেপ কূটনৈতিক স্তরে সীমাবদ্ধ। ফলে ট্রাম্পের এই ‘শান্তি প্রয়াস’ এখন পর্যন্ত মূলত শব্দচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
রাজনীতির মোড় ঘোরাতে ট্রাম্পের ‘শান্তি ব্র্যান্ডিং’
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২8 সালের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ট্রাম্প এখন রাজনীতির মাঠ গরম করতে চাইছেন। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও বিচারগত চাপের মধ্যে আন্তর্জাতিক কূটনীতি তাঁর বিকল্প প্রচারভিত্তি হয়ে উঠেছে। ট্রাম্প জানেন, যুদ্ধ থামানো প্রেসিডেন্টকে বিশ্ব ইতিহাসে 'শান্তির নায়ক' হিসেবে দেখায়।
সেই নায়কত্বের চূড়ান্ত পুরস্কারই তাঁর কাছে নোবেল।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতিতে হস্তক্ষেপ নিছক মানবিক দায় নয়। এটি তাঁর রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। তিনি ‘শান্তির নেতা’ ইমেজ নির্মাণে ব্যস্ত, যার পেছনে রয়েছে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভের সুস্পষ্ট অভিপ্রায়।
ভারত-পাকিস্তান বা ইরান-ইজরায়েল—যে যুদ্ধই হোক, ট্রাম্প এই দ্বন্দ্বগুলিকে নিজের কৌশলগত ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে দেখছেন। প্রশ্ন হলো—বিশ্ব কি এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাবে? না কি একে ট্রাম্পীয় মার্কেটিং হিসেবেই দেখবে?
বিশ্ববাসী হয়তো অপেক্ষায় আছে—একজন রাজনীতিকের শান্তি প্রয়াস নোবেলের মাপকাঠিতে কতটা সত্য ও কার্যকর প্রমাণিত হয়।