রাজকুমার বসাক (মানবাধিকার কর্মী)
ভারতবর্ষের সংবিধানের ৩২৪ থেকে ৩২৯ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত দেশের আইনসভার নির্বাচন, তার পরিচালনা, দেশের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো বলা আছে। সেইমতো দেশের রাষ্ট্রপতি, লোকসভা, রাজ্যসভা ও বিধানসভা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। অথচ এসআইআর-এর ক্ষেত্রে আমরা দেখছি নির্বাচন কমিশন সংবিধান মানছে না, আইন মানছে না।
"ভারতের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০' অনুসারে ১৮ বছরের উর্ধ্বে ভারতীয় নাগরিক, যিনি মানসিক অসুস্থ নন বা শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধী নন, নির্বাচনে মতদানের জন্য ভোটার তালিকায় নাম তোলার অধিকারী।" (১৬ ও ১৮ নং ধারা) ভোটার তালিকায় নাম তুলতে গেলে সাবালক নাগরিককে "ভোটার নিবন্ধন বিধি, ১৯৬০" অনুযায়ী ৬ নং ফর্মের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে এবং তাতে ভারতীয় নাগরিক বলে ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু ফর্মের কোথাও নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে কোন নথি দাখিল করার কথা বলা হয়নি। নাগরিকত্ব যাচাই করে ভোটার তালিকায় নাম তোলার কোন এক্তিয়ার নেই নির্বাচন কমিশনের। আইন অনুসারে, ৬ নং ফর্মে নাগরিক হিসেবে ঘোষণাই যথেষ্ট। ফর্মেই লেখা আছে, ঘোষণা মিথ্যা প্রমানিত হলে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৩১ নং ধারা অনুসারে কারাদণ্ড হবে আবেদনকারীর। আবেদনকারী যে নাগরিক নয় তা প্রমাণ করার দায়িত্ব সরকারের। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে তথ্যপ্রমাণের দ্বারা প্রমাণ করতে হবে, সেই ব্যক্তি ভারতের নাগরিক নন। অথচ এসআইআর -এ এক্তিয়ার বহির্ভূতভাবে আইন না মেনে নির্বাচন কমিশন গা-জোয়ারি করে ইচ্ছামত ডকুমেন্ট চাইছে। এই অতিরিক্ত আইনি বাধা সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের (সংবিধানের ৩২৬ অনুচ্ছেদ) লঙ্ঘন করছে।
এমনকি ডকুমেন্ট হিসেবে যে ভোটার কার্ড তারা নিজেরাই ইস্যু করেছে, সেটাও গ্রাহ্য করছে না। কমিশনের হাস্যকর যুক্তি, এগুলো জাল হয়, এগুলো নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। কমিশন নিশ্চিত, বাকি ডকুমেন্ট জাল হয় না? রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট, কাস্ট সার্টিফিকেট জাল হয় না? কমিশনের মতে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। প্রশ্ন হলো, এলআইসি সার্টিফিকেট, মাধ্যমিক সার্টিফিকেট এগুলো নাগরিকত্বের প্রমাণ? এর কোন উত্তর কমিশনের কাছে নেই।
এমন অনেক প্রশ্নের উত্তরই কমিশনের কাছে নেই। কোন আইনে তারা এসআইআর করছে, তার সদুত্তর তাদের কাছে নেই। আইন অনুসারে নিবিড় সংশোধনী (Intensive Revision), সারসংক্ষেপ বা সামারি সংশোধনী (Summary Revision), অংশত নিবিড় (Partly Intensive) বা অংশত সামারি Partly Summary) সংশোধনীর ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও কোন একটি কেন্দ্রের বা তার কোন অংশের জন্য বিশেষ কারণে (যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি) বিশেষ সংশোধন (Special Revision) হতে পারে। কিন্তু আইনের কোথাও দেশজুড়ে এমন "বিশেষ নিবিড় সংশোধন"-এর কথা বলা নেই।
কমিশন বলছে ২০০৩ সালে বিহারে, ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর হয়েছিল। এ মিথ্যাচার। এর কোন তথ্য-প্রমাণ নির্বাচন কমিশন দিতে পারেনি। বিহারে এসআইআর চলাকালীন তথ্যের অধিকার আইনে, ২০০৩ সালের এসআইআর-এর বিজ্ঞপ্তির প্রতিলিপি চাওয়া হয়েছিল। উত্তরে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সেই প্রতিলিপি তাদের দপ্তরে নেই। অথচ সেই নির্বাচন কমিশন ১৯৮৭ সালের আগের, আমার আপনার বাবা-মায়ের জন্মের কাগজ চাইছে!
নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গে ২০০২ সালের পরবর্তী সমস্ত ভোটার তালিকা অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। যে ভোটার তালিকার ভিত্তিতে নির্বাচন হয়েছে, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, সেই ভোটার তালিকা বাতিল হলে, প্রধানমন্ত্রীত্ব বাতিল হয়ে যায় না কি?
আসলে দেশজুড়ে এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে সরকার পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এসআইআর-এর মাধ্যমে ঘুরপথে তা আবার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। যে তথ্য তারা চাইছে, ২০১৯ সালে সেই তথ্যগুলোই এনপিআর-এ চাওয়া হয়েছিল। অমিত শাহ-র "ক্রনোলজি" মেনে এনপিআর-এনআরসি-সিএএ। মনে রাখতে হবে, এসআইআর-এর ডামাডোল চলতে চলতেই ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ কেন্দ্র সরকার পুরনো আইন গুলি বাতিল করে "অভিবাসন ও বিদেশী আইন, ২০২৫" পাশ করিয়েছে। এই আইনে একজন হেড কনস্টেবলও সন্দেহের বশে কাউকে আটক করতে পারে। আর ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়ে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে দিচ্ছে এসআইআর। এই আইনে বলছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের ছাড় দেওয়া হবে। সিএএ-তে যা বলা হয়েছিল। আন্দোলনের চাপে যা তারা করতে পারেনি, ঘুরিয়ে তা করার চক্রান্ত করছে।
নির্বাচন কমিশন বিজেপি-আরএসএস-এর শাখা সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। এদের কাছে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রত্যাশা করা যায় না। ২০১৫ সালের আইন কমিশনের সুপারিশ ও ২০২৩ সালের সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ছিল, নির্বাচন কমিশনারদের নির্বাচনের জন্য তিনজনের নির্বাচক কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচন কমিশনারদের নির্বাচন সংক্রান্ত আইন বদলে ফেলে। প্রধান বিচারপতির জায়গায় আনা হয় প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। বর্তমানে প্রধান বিচারপতির জায়গায় আছেন মন্ত্রী অমিত শাহ। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য, অমিত শাহ প্রধানমন্ত্রীর মতের বিরোধিতা করবেন? তিনের মধ্যে দুই সব সময় সরকার পক্ষের। আর তাঁদের নির্বাচিত নির্বাচন কমিশনাররা নিরপেক্ষ হবে, এ সোনার পাথরবাটি।
আসলে এসআইআর-এর উদ্দেশ্য স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরি করা নয়। সর্বজনীন ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার এ এক গভীর ষড়যন্ত্র। আরএসএস সর্বজনীন ভোটাধিকার ধারণার বিরোধী। আরএসএসের মুখপত্র "অর্গানাইজার"-এর ১৯৪৯ সালের ৩০ নভেম্বর সংখ্যায় লেখা হয়, "পশ্চিমা ধাঁচে সর্বজনীন ভোটাধিকার ভারতীয় সমাজে বিপদজনক ফল বয়ে আনবে।" তাঁদের বক্তব্য ছিল, অশিক্ষিত গরিব মানুষ ভোট দিতে সক্ষম নয়, কেবলমাত্র "যোগ্য শ্রেণি" শাসনে অংশ নিতে পারবে। এই "যোগ্য শ্রেণি" কারা? উচ্চবিত্ত হিন্দুর সুবিধাভোগী এক অংশ। তাই লক্ষ্য করে দেখবেন, এসআইআর-এ (বিহারে) লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের নাম বাদ গেছে এবং ভবিষ্যতে আরো যাবে। তাই সর্বজনীন ভোটাধিকার রক্ষার স্বার্থে, আইন-বহির্ভূত, সংবিধান বিরোধী এসআইআর-এর নীতিগত বিরোধিতা আমাদের নাগরিক কর্তব্য। 
