পিয়া রায়
রূপ নিয়ে সমাজের মানদণ্ড সবসময়ই ছিল কড়া। গায়ের রঙ যেন হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের মাপকাঠি। অথচ এই রঙই কারও জীবনে হয়ে দাঁড়ায় কষ্ট, বিচ্ছিন্নতা ও সামাজিক বঞ্চনার কারণ। ঠিক এমন এক চর্মরোগ ‘ভিটিলিগো’, যা মানুষের গায়ের রঙের স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দেয়, শরীরজুড়ে সৃষ্টি করে সাদা দাগ। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো—এই রোগের শারীরিক কষ্টের চেয়েও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির যন্ত্রণাই বেশি পীড়াদায়ক। সেই উপলব্ধি থেকেই প্রতিবছর ২৫ জুন পালিত হয় World Vitiligo Day, যার মূল উদ্দেশ্য—এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা ছড়ানো, সামাজিক কুসংস্কার ভাঙা এবং ভিটিলিগো আক্রান্ত মানুষদের মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
ভিটিলিগো আসলে একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীর নিজেই তার রঞ্জক কোষ মেলানোসাইট ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে ত্বকে ছোপ ছোপ সাদা দাগ দেখা দেয়। এই রোগ সংক্রামক নয়, ছোঁয়াচেও নয়, এবং কারও জীবনের গড় আয়ু বা শারীরিক সক্ষমতাতেও এর প্রভাব পড়ে না। কিন্তু তবুও সমাজ এই রোগকে দেখে ভয়ের চোখে, অবজ্ঞার দৃষ্টিতে। অনেকেই মনে করেন এটি অভিশাপ, পাপের ফল বা ছোঁয়াচে রোগ—যা থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এই কুসংস্কার আরও গভীর। ভিটিলিগো আক্রান্ত মানুষদের অনেক সময় স্কুলে ঠাট্টার পাত্র হতে হয়, চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হয়, এমনকি বিবাহের ক্ষেত্রেও কঠিন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে তো আরও ভয়াবহ, সমাজের চোখে রঙে দাগ মানে তার সৌন্দর্য, যোগ্যতা সব কিছুতেই ‘কমতি’। অথচ এই মেয়েটি হয়তো খুব মেধাবী, দায়িত্বশীল ও স্বনির্ভর। কিন্তু তার ত্বকে সাদা দাগ দেখে মানুষ তাকে ‘অযোগ্য’ বলে ফেলে।
এইসব অযৌক্তিক ভাবনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই World Vitiligo Day-এর প্রধান লক্ষ্য। এই দিনটি শুধুই একটা চর্মরোগ নিয়ে কথা বলার দিন নয়, এটি সমাজকে আয়নায় মুখোমুখি দাঁড় করানোর দিন। প্রশ্ন করার দিন—“রঙেই কি সব?” একজন মানুষের ভালোবাসা, প্রতিভা, আত্মবিশ্বাস কি শুধু তার গায়ের রঙ দিয়ে বিচারযোগ্য?
আজ দরকার সচেতনতার আলো ছড়ানো। ডাক্তারি বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এখন ভিটিলিগো নিয়ন্ত্রণে আনার অনেক উপায় রয়েছে। চিকিৎসা যেমন দরকার, তেমনি দরকার মানসিক শক্তি এবং সামাজিক সমর্থন। পরিবার, বন্ধু, প্রতিষ্ঠান—সবারই উচিত এই রোগ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা, ভয়ের নয়, বোঝাপড়ার জায়গা তৈরি করা।
বিশ্বাস গড়ে উঠুক রঙের ওপরে নয়, হৃদয়ের গভীরে। সমাজ তখনই সত্যিকার অর্থে মানবিক হবে, যখন একজন মানুষকে দেখা হবে তার চরিত্র, কর্ম ও মেধার ভিত্তিতে—not by the color of their skin, but by the content of their character. World Vitiligo Day হোক সেই বিবর্তনের সূচনা।