আর বিপ্লব
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, কালিগঞ্জ বিধানসভায় অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস জয়লাভ করেছে। এই জয়ের পেছনে নানা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ উঠে আসছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান এখন আলোচনার কেন্দ্রে—কালিগঞ্জের ৩০৯টি বুথের মধ্যে ১০৯টি ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বুথ, যার মধ্যে বিজেপি এগিয়ে থেকেছে ১০৮টিতেই। এই ফলাফল অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—এ কি হিন্দু ভোটারদের মধ্যে একটি ‘ঐক্যবদ্ধ মনোভাবের’ সূচনা? সেকুলার রাজনীতির অনুসারীরা কি এই পরিবর্তনকে এখন বাস্তবভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন?
কালিগঞ্জ বিধানসভা আসনটি মূলত নদিয়া জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এই আসনে উপনির্বাচন হয় তৃণমূল বিধায়ক মৃত্যুর কারণে। তৃণমূল কংগ্রেস এবার এখান থেকে তাদের প্রার্থী জয়ী করে কেন্দ্রটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। যদিও পুরো নির্বাচনে জয়ী হয়েছে তৃণমূল, কিন্তু বুথভিত্তিক ফলাফল খতিয়ে দেখলে বিজেপির পারফরম্যান্স বিশেষত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলিতে লক্ষণীয়ভাবে ভালো ছিল।
১০৯টি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বুথের মধ্যে বিজেপি এগিয়ে থেকেছে ১০৮টিতে। এই পরিসংখ্যান নিছক কাকতালীয় নয়, বরং একটি সুস্পষ্ট ধারা নির্দেশ করে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, অন্তত এই নির্বাচনে হিন্দু ভোটারদের একটি বড় অংশ বিজেপির পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
এটা কি ধর্মীয় কারণে? না কি প্রশাসনিক ক্ষোভ, স্থানীয় ইস্যু, কিংবা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অনাস্থা? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে গেলে কিছু বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।
ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ধর্মীয় পরিচিতি এবং জনসংখ্যার সাম্প্রতিক গতিপ্রবাহ ভোট রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলছে। বাংলার মতো একটি রাজ্যে যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা ৩০ শতাংশের কাছাকাছি, সেখানে হিন্দু ভোটের ‘বিভাজন’ বরাবরই তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে কাজ করেছে।
তবে কালিগঞ্জের ফলাফল এই ধারার একটি ব্যতিক্রম হিসেবে উঠে এসেছে। ৯৯ শতাংশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বুথে বিজেপির লিড স্পষ্ট করে দেয় যে, হিন্দু ভোটের মধ্যে একটি সংগঠিত স্রোত তৈরি হচ্ছে। এটা একদিকে ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধি, অন্যদিকে শাসক দলের বিরোধী ভোটের এককেন্দ্রীকরণের ফল হতে পারে।
সাম্প্রতিক কালে তথাকথিত ‘সেকুলার’ দলগুলোর মধ্যে বিজেপিকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মুসলিম ভোট ব্যাংকের দিকে অতিরিক্ত নির্ভরতা লক্ষ্য করা গেছে। এর ফলে একটি বড় সংখ্যক হিন্দু ভোটার নিজেদের অবহেলিত মনে করছেন বলে অভিযোগ উঠে এসেছে।
কালিগঞ্জ উপনির্বাচনের ফলাফল হয়তো এই সেকুলার নেতৃত্বকে প্রথমবারের মতো বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তারা বুঝতে পারছেন, মুসলিম ভোটে নির্ভরশীলতা শুধু পর্যাপ্ত নয়, বরং হিন্দুদের উদ্বেগকে অগ্রাহ্য করলে ফল উল্টো হতে পারে।
বিজেপি গত কয়েক বছর ধরে রাজ্যে একটি ধারাবাহিক ধর্মীয় মেরুকরণ কৌশল গ্রহণ করেছে। ‘হিন্দু স্বার্থ’, ‘বাংলা সংস্কৃতি’, ও ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ ইস্যুকে সামনে এনে তারা হিন্দু ভোটারদের মধ্যে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেস দলীয় সংগঠন, অর্থনৈতিক সাহায্য, স্থানীয় নেতৃত্বের প্রভাব এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে ভোটব্যাংক ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। কালিগঞ্জে তার সুফল মিলেছে; কিন্তু সেটি মোট ফলাফলে, বুথভিত্তিক প্রবণতায় বিজেপির সাফল্য রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিক নির্দেশ করছে।
এই ফলাফলকে একটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক ঘটনা বললে অত্যুক্তি হবে না। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৯ সালের লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে হিন্দু ভোটারদের একত্রীকরণ বিজেপির বড় অস্ত্র হতে পারে।
সেকুলার দলগুলোর জন্য এটা একটি সতর্কবার্তা—একতরফা মুসলিম তোষণ নয়, বরং সামগ্রিক জনগণের মনোভাব বুঝে পরিমিত ও ভারসাম্যপূর্ণ রাজনীতি সময়ের দাবি।
কালিগঞ্জ উপনির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ধর্মীয় পরিচিতি, ভোটের সংগঠিত স্রোত, এবং সেকুলার রাজনীতির মানসিক রূপান্তর—এই তিনটি বিষয় এখন কেন্দ্রীয় আলোচনার জায়গা।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বুথে বিজেপির ব্যাপক অগ্রগতি নিছক উপনির্বাচনের ফল নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক সম্ভাব্য পরিবর্তনের সূচনা। এখন সময়—সকল দলের কাছে এই পরিবর্তনের ভাষা বোঝার, তা অগ্রাহ্য করলে ভবিষ্যৎ আরও চমকপ্রদ হতে পারে।