Select language to read news in your own language

দাবার দেশে ঈশ্বরের আর্শীবাদ — তামিল সংস্কৃতির ছায়ায় ভারতের Chess Revolution

আর বিপ্লব

 

ভারতীয় দাবার ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত উঠে এসেছে সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক লাইভ রেটিং তালিকায়। এই প্রথম, একসঙ্গে চারজন ভারতীয় দাবাড়ু বিশ্বের শীর্ষ ১০ দাবাড়ুর তালিকায় প্রবেশ করেছেন। এবং আশ্চর্যের বিষয়, চারজনই দক্ষিণ ভারতের সন্তান। ডি. গুকেশ (বিশ্ব ৪ নম্বর, Elo 2782.3), অর্জুন এরিগাইসি (বিশ্ব ৫ নম্বর, Elo 2772.6), আর. প্রজ্ঞানন্দ (বিশ্ব ৭ নম্বর, Elo 2765.9) এবং অরবিন্দ চিথম্বরম (বিশ্ব ১০ নম্বর, Elo 2753.5) – এঁরা সবাই এমন এক ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি থেকে উঠে এসেছেন যেখানে দাবা শুধু খেলা নয়, একধরনের ঈশ্বরপূজা।

এই অসাধারণ অর্জনের পেছনে শুধু কৌশল, অধ্যবসায় বা প্রশিক্ষণই নয়, রয়েছে এক আধ্যাত্মিক বিশ্বাস এবং প্রাচীন ঐতিহ্যের ছোঁয়া। দক্ষিণ ভারতের, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর মানুষ মনে করেন, দাবার দেবতা হচ্ছেন ভগবান শিবের এক বিশেষ রূপ — সাথুরঙ্গ বল্লভনাথর। ‘সাথুরঙ্গ’ অর্থাৎ দাবা এবং ‘বল্লভনাথর’ অর্থাৎ প্রভু — এই নামে তাঁকে পুজো করা হয় দাবা খেলার কর্তা হিসেবে। কিংবদন্তি বলে, ভগবান শিব এক রাজকন্যার সঙ্গে বিবাহের জন্য তাঁকে দাবায় পরাজিত করেন। সেই দিন থেকেই দাবা খেলাটি শুধু এক বুদ্ধির খেলা নয়, হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক সাধনার অংশ।

এই বিশ্বাস শুধু লোককথা নয়, বাস্তব ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রমাণে পূর্ণ। তামিলনাড়ুর তিরুপুরুর এলাকায় অবস্থিত সাথুরঙ্গ বল্লভনাথর মন্দির আজও প্রমাণ করে, এই রাজ্য ও দাবা খেলার সম্পর্ক কতটা প্রাচীন এবং গভীর। সেখানে দাবা একটি ধর্মীয় রীতি, একধরনের পূজা। শিশুরা শৈশব থেকেই দাবার সঙ্গে পরিচিত হয়, খেলাটিকে গেম না ভেবে 'ধ্যান' বা 'সাধনা' হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে দাবা তাদের কাছে হয়ে ওঠে প্রতিদিনের জীবনের অংশ, এবং এই মানসিক প্রস্তুতিই হয়তো তাঁদের আন্তর্জাতিক স্তরে জয়ী করে তুলেছে।

শুধু বর্তমান নয়, অতীতেও তামিলনাড়ু দাবার এক মহাশক্তি হিসেবে পরিচিত। ভারতীয় দাবার প্রবাদপ্রতিম গ্র্যান্ডমাস্টার বিশ্বনাথন আনন্দ-এর নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল। তামিলনাড়ু তাঁর জন্মভূমি। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করেই আজকের এই প্রতিভাবান তরুণেরা দাবা বিশ্বমঞ্চে ভারতের পতাকা তুলে ধরছেন।

একথা অনস্বীকার্য যে, তামিল সংস্কৃতির মধ্যে একটি গভীর 'ক্যালকুলেটিভ' ভাবনা জড়িয়ে আছে। স্কুল পর্যায়ে দাবার আলাদা ক্লাস, পরিবারে দাবা খেলাকে উৎসাহ, এবং সামগ্রিক সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা — সব মিলিয়ে দাবা খেলোয়াড় তৈরির এক স্বর্গতুল্য পরিবেশ গড়ে উঠেছে। কিন্তু এর বাইরেও, তামিল সমাজ দাবাকে যেভাবে 'দেবতার আশীর্বাদ' ও 'ধ্যানমূলক সাধনা' হিসেবে দেখে, সেটাই হয়তো এই সাফল্যের আসল চাবিকাঠি।

শুধু তামিলনাড়ু নয়, গোটা দক্ষিণ ভারতেই দাবাকে ঘিরে এক আধ্যাত্মিক আবহ দেখা যায়। দেবতার উদ্দেশ্যে দাবা খেলা, মন্দিরে দাবার প্রতীকী উপস্থাপনা, বা ঈশ্বরের সঙ্গে দাবা খেলার কল্পনাকে ধ্যান হিসেবে নেওয়া — এ সমস্তই দাবাকে শুধুমাত্র 'বুদ্ধির খেলা' থেকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়।

এই বিশ্বাস ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারার এক অনন্য প্রকাশ। যেখানে খেলা, জীবন এবং ঈশ্বর — তিনটিই একত্রে মিশে যায়। তাই দাবা খেলোয়াড়রা শুধু কৌশলে নয়, মানসিক শান্তি এবং আত্মবিশ্বাসেও এগিয়ে থাকেন। তাদের প্রতিটি চাল যেন এক 'ধ্যান', প্রতিটি খেলা যেন 'তপস্যা'।

আধুনিক বিশ্বে যেখানে প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণ ছাড়া সাফল্য কল্পনা করা যায় না, সেখানে দক্ষিণ ভারতের এই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি দাবা খেলাকে দিয়েছে এক অনন্য রূপ। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু খেলোয়াড় তৈরি করে না, তৈরি করে অনুপ্রাণিত মানবচরিত্র। হয়তো এটাই সেই কারণ, যে কারণে দক্ষিণ ভারতের দাবাড়ুরা বার বার ভারতের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে।

আজ যখন বিশ্বের দাবা মানচিত্রে ভারত শীর্ষে পৌঁছেছে, তখন আমাদের পিছনে ফিরে তাকানো উচিত সেই সংস্কৃতির দিকে, যেখানে দাবা এক প্রাচীন সাধনার অংশ। যেখানে সাথুরঙ্গ বল্লভনাথর এখনও পূজিত হন, এবং যেখানে প্রতিটি চাল যেন ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতিফলন।

তাই বলা যায়, দাবার এই উত্থান শুধু একক কোন প্রতিভার ফল নয়, বরং এক বৃহৎ সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, অধ্যবসায়, আধ্যাত্মিকতা ও ঐতিহ্যের সম্মিলিত প্রতিফলন। দাবা খেলায় ভারতের আধিপত্যের মূলে যদি সত্যিই কোনও ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদ’ থাকে, তবে তা এসেছে দক্ষিণ ভারতীয়দের বিশ্বাস থেকে—যেখানে প্রতিটি দাবার বোর্ডে দেখা যায় ভগবান শিবের ছায়া।

 

ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon