পিয়া রায়
কানাডায় দুর্গাপুজো আজ এক উজ্জ্বল প্রবাসী ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, যা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সামাজিক বন্ধনের এক প্রাণবন্ত প্রতিচ্ছবি। দেশটিতে বসবাসরত ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিদের উদ্যোগে প্রতি বছর শরৎকালে এই পূজো অনুষ্ঠিত হয়। টরন্টো, ভ্যাঙ্কুভার, ক্যালগারি, মন্ট্রিয়াল, অটোয়া এবং এডমন্টনসহ কানাডার বিভিন্ন শহরে দুর্গাপুজো এখন একটি পরিচিত বার্ষিক আয়োজন। সাধারণত স্থানীয় মন্দির, কমিউনিটি সেন্টার, স্কুল অডিটোরিয়াম কিংবা বড় হলঘরে পূজার আয়োজন করা হয়, যেখানে প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনসহ সমবেত হন।
এখানকার দুর্গাপুজোতে বাংলার ঐতিহ্যবাহী রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করা হলেও প্রবাস জীবনের প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত মূল আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মজীবী মানুষদের সুবিধার জন্য সপ্তাহান্তে পূজার আয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। পূজা পরিচালনার জন্য প্রতিমা অনেক সময় কলকাতা বা বাংলাদেশের কারিগরদের কাছ থেকে অর্ডার করে আনা হয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় শিল্পীরাও মাটি, কাঠ বা ফাইবারগ্লাস দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করেন।
পুজোর মণ্ডপ সজ্জায় কানাডায় বৈচিত্র্যের ছোঁয়া পাওয়া যায়। প্রবাসীরা অনেক সময় বাংলা সংস্কৃতির গ্রামীণ বা নগর জীবনের দৃশ্য তুলে ধরেন, আবার কখনও আধুনিক ডিজাইন ও আলোসজ্জা দিয়ে মণ্ডপকে মনোরম করে তোলেন। ঢাকের বাদ্য, উলুধ্বনি, ধুনুচি নাচ—সবই এখানে যথাসম্ভব আয়োজনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়, যা প্রবাস জীবনের মাঝেও অংশগ্রহণকারীদের মনকে মাতিয়ে তোলে।
ভোগের আয়োজন কানাডার দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ। খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি, পায়েস—সবই যতটা সম্ভব ঐতিহ্যবাহীভাবে প্রস্তুত করা হয়, যদিও অনেক সময় স্থানীয় বাজারের উপকরণ ব্যবহার করতে হয়। পূজার দিনগুলোতে ভোগ পরিবেশনকে কেন্দ্র করে সামাজিক মিলনমেলার আবহ তৈরি হয়, যেখানে সবাই নিজের পরিচিতি ছাড়িয়ে এক বড় পরিবারে পরিণত হয়।
দুর্গাপুজো কানাডায় শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও বটে। পূজার মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, এমনকি সমকালীন সংগীত পরিবেশন করা হয়। ছোটরা অংশ নেয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায়, যা তাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করে। অনেক পূজায় ভারত বা বাংলাদেশ থেকে খ্যাতনামা শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, যা প্রবাস জীবনে বিশেষ আনন্দের যোগান দেয়।
কানাডায় দুর্গাপুজো প্রায়শই বহুজাতিক দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। স্থানীয় কানাডিয়ান বা অন্য দেশের মানুষও ঢাকের তালে ধুনুচি নাচে অংশ নেন, সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন এবং ভোগের স্বাদ নেন। এতে উৎসবটি এক আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে, যা বাঙালি ঐতিহ্যকে বৈশ্বিক পরিসরে পৌঁছে দেয়।
দশমীর দিনে প্রতিমা বিসর্জন সাধারণত প্রতীকীভাবে করা হয়, কারণ এখানে প্রাকৃতিক জলাশয় ব্যবহারের সুযোগ সীমিত। অনেকে প্রতিমা সংরক্ষণ করেন বা পুনঃব্যবহার করেন, তবে বিসর্জনের সময় আবেগের স্রোত বাংলার মতোই গভীর থাকে।
সব মিলিয়ে, কানাডায় দুর্গাপুজো প্রমাণ করে যে ভৌগোলিক দূরত্ব সংস্কৃতিকে থামাতে পারে না। এটি প্রবাসী বাঙালিদের হৃদয়ের সঙ্গে শিকড়ের সম্পর্ককে অটুট রাখে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। এখানে দুর্গাপুজো মানে শুধু দেবীর আরাধনা নয়, বরং একতা, আনন্দ এবং প্রবাস জীবনে আপনজনের মতো এক সমবেত পরিবারের উষ্ণতা।
ছবি: সংগৃহীত

