পিয়া রায়
চিলিতে দুর্গাপুজো তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও প্রবাসী বাঙালি ও ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। চিলিতে বাঙালি বসতি খুব বেশি বড় নয়, তবে স্যান্টিয়াগো ও আশপাশের শহরগুলোতে কর্মসংস্থান, ব্যবসা এবং শিক্ষার সুযোগের কারণে ক্রমে একটি ছোট কিন্তু সক্রিয় কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। এই কমিউনিটিই দুর্গাপুজোর প্রচলন শুরু করে। প্রাথমিকভাবে পূজা ছিল ঘরোয়া, কয়েকটি পরিবার একত্রিত হয়ে প্রতিমার পরিবর্তে দেবী দুর্গার ছবি স্থাপন করে চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলি ও ভোগ পরিবেশন করতেন। ধীরে ধীরে পূজার আয়োজন বড় হতে থাকে এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যুক্ত হয়, যা প্রবাস জীবনে এক অনন্য মিলনমেলায় পরিণত হয়।
বর্তমানে সান্তিয়াগো শহরে দুর্গাপুজো সংগঠনের মূল কেন্দ্র। এখানে প্রবাসী বাঙালিদের পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং বাংলাদেশের নাগরিকরাও যুক্ত হন। অনেক সময় চিলির অন্যান্য শহর থেকেও পরিবার আসেন অংশ নিতে। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পূজার প্রতিটি দিনে ধর্মীয় আচার, পূজা-অর্চনা, অঞ্জলি প্রদান এবং প্রসাদ বিতরণ হয়। ভোগের মেনুতে থাকে বাঙালি ঐতিহ্যের খাবার—খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি। স্থানীয় উপকরণের সীমাবদ্ধতার কারণে মাঝে মাঝে রান্নায় চিলির স্থানীয় সবজি ও মসলা ব্যবহার করা হয়, যা খাবারে এক ভিন্ন স্বাদ যোগ করে।
চিলিতে দুর্গাপুজো কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি প্রবাসীদের কাছে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। পূজার সময় সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি ও নাটকের আয়োজন করা হয়, যেখানে প্রবাসী শিশু-কিশোরেরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এ ধরনের অনুষ্ঠান তাদের শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চাকে উৎসাহিত করে। পাশাপাশি স্থানীয় চিলিয়ান বন্ধুরা ও প্রতিবেশীরাও প্রায়ই অনুষ্ঠানে যোগ দেন, ঢাকের তালে নাচেন, সিঁদুর খেলায় অংশ নেন এবং ভোগের স্বাদ গ্রহণ করেন। এতে দুর্গাপুজো এক আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়ের রূপ নেয়, যেখানে দুটি ভিন্ন সংস্কৃতি মিলেমিশে যায়।
দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের আয়োজন চিলিতে সাধারণত প্রতীকীভাবে হয়। এখানে নদী বা জলাশয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া সবসময় সম্ভব হয় না, তাই অনেক সময় প্রতিমা সংরক্ষণ করে রাখা হয় বা কেবল প্রতীকী বিদায় অনুষ্ঠান করা হয়। বিসর্জনের আগে ঢাক, কাঁসা, শঙ্খধ্বনি এবং সিঁদুর খেলায় শেষ দিনের পরিবেশ আনন্দ ও আবেগে ভরে ওঠে।
চিলির দুর্গাপুজোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো স্থানীয় প্রভাব। মণ্ডপসজ্জায় প্রায়ই চিলির উজ্জ্বল রঙ, ফুল ও শিল্পকর্মের প্রভাব দেখা যায়। কখনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চিলির ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ও সঙ্গীত যুক্ত হয়, যা উৎসবকে আরও বৈচিত্র্যময় করে। এই মিলন শুধু বাঙালি প্রবাসীদের মধ্যে নয়, বরং চিলির স্থানীয় সমাজেও উৎসব সম্পর্কে কৌতূহল ও শ্রদ্ধা জাগায়।
সব মিলিয়ে চিলিতে দুর্গাপুজো একটি সেতুবন্ধন—যা দূর দেশে থেকেও মানুষকে তার ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত রাখে এবং একই সঙ্গে নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। এটি প্রমাণ করে, দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যেরও এক অনন্য উদযাপন, যা ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে মানুষের হৃদয়ে একই আবেগ জাগায়।
ছবি: সংগৃহীত

