পিয়া রায়
ব্রাজিলে দুর্গাপুজো তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও এর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ক্রমশ বাড়ছে, বিশেষত সেখানকার প্রবাসী ভারতীয় ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত লোকজন, মূলত ব্যবসা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য ব্রাজিলে বসতি স্থাপন শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাঙালিদের একটি ছোট কিন্তু সক্রিয় অংশ রয়েছে। এই সম্প্রদায়ই দুর্গাপুজোকে ব্রাজিলের মাটিতে পরিচিত করে তোলে। শুরুতে এটি ছিল ঘরোয়া আয়োজন, কয়েকটি পরিবার মিলে মূর্তি বা ছবি স্থাপন করে পূজা করতেন, চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলি ও ভোগ বিতরণ হতো সীমিত পরিসরে।
বর্তমানে সাও পাওলো, রিও ডি জেনেইরো এবং ব্রাজিলিয়ার মতো শহরে দুর্গাপুজো কিছুটা বড় আকার পেয়েছে। সাও পাওলো শহরে ‘বাংলা অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রাজিল’ ও স্থানীয় ভারতীয় কমিউনিটি মিলে প্যান্ডেল সাজিয়ে, মাটির বা ফাইবারের প্রতিমা স্থাপন করে এবং চার-পাঁচ দিনের পূজার আয়োজন করে। পূজার মূল দিনগুলো—ষষ্ঠী থেকে দশমী—ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ভোগ বিতরণ ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে উদযাপিত হয়। ভোগের তালিকায় খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি থাকে, যা অনেক সময় ব্রাজিলের স্থানীয় সবজি ও মসলার প্রভাবে একটু ভিন্ন স্বাদ পায়।
ব্রাজিলের দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় আচারেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা প্রবাসীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। পূজার মঞ্চে নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, নাটক ও ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শিশু থেকে প্রবীণ—সবাই অংশ নেয়। এ ধরনের অনুষ্ঠান প্রবাসে বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মকে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত রাখে। এখানে প্রায়ই ব্রাজিলীয় বন্ধুরা ও প্রতিবেশীরাও আমন্ত্রিত হন, যারা ঢাকের তালে নাচ, সিঁদুর খেলা ও ভোগের স্বাদ নিতে ভালোবাসেন। এর ফলে দুর্গাপুজো এক আন্তঃসাংস্কৃতিক উদযাপনে রূপ নেয়।
দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের আয়োজন ব্রাজিলে পরিবেশগত ও লজিস্টিক কারণে অনেক সময় প্রতীকীভাবে পালন করা হয়। মূর্তি সংরক্ষণ করে রাখা হয়, অথবা নদী বা হ্রদে সীমিত আকারে বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের আগে ঢাক, কাঁসা, শঙ্খধ্বনি এবং নারীদের সিঁদুর খেলায় শেষ দিনের আবহ আনন্দ ও বিষাদের মিশ্রণে ভরে ওঠে।
ব্রাজিলে দুর্গাপুজোর গুরুত্ব শুধু ধর্মীয় অনুশীলনের মধ্যেই সীমিত নয়; এটি প্রবাসীদের আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্য ধরে রাখার এক শক্তিশালী মাধ্যম। এমনকি স্থানীয় ব্রাজিলীয় সংস্কৃতির ছোঁয়ায় এই পূজা আরও রঙিন ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, মণ্ডপ সজ্জায় অনেক সময় ব্রাজিলের উজ্জ্বল রঙ ও ফুলের ব্যবহার দেখা যায়, আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে সাম্বা বা স্থানীয় নৃত্যের সংমিশ্রণও ঘটে।
ফলে ব্রাজিলে দুর্গাপুজো কেবল প্রবাসী বাঙালিদের নয়, বরং দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে এক সেতুবন্ধন। এটি প্রমাণ করে, মাতৃভূমি থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও ঐতিহ্যকে লালন ও উদযাপন করা সম্ভব, আর সেই প্রক্রিয়ায় অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি করা যায় নতুন, বহুমাত্রিক উদযাপনের রূপ।
ছবি: সংগৃহীত

