পিয়া রায়
উগান্ডায় দুর্গাপুজো মূলত ভারতীয় ও বাঙালি প্রবাসী সম্প্রদায়ের উদ্যোগে আয়োজিত হয়। পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটির জনসংখ্যার বিশাল অংশ খ্রিস্টান ও মুসলিম হলেও, প্রায় এক শতাব্দী আগে থেকে এখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত একটি ক্ষুদ্র কিন্তু প্রভাবশালী সম্প্রদায় বসবাস করছে। ১৯০০-এর দশকের শুরুতে রেলপথ নির্মাণ ও ব্যবসার কাজে ভারতীয় শ্রমিক ও উদ্যোক্তারা পূর্ব আফ্রিকায় আসেন, যাদের উত্তরসূরিরা এখনও উগান্ডার সমাজ ও অর্থনীতিতে সক্রিয়। তাঁদের মধ্যে গুজরাটি, পাঞ্জাবি, তামিল, সিন্ধি এবং বাঙালি পরিবারের উপস্থিতি রয়েছে। এই বাঙালি পরিবারগুলিই প্রবাসের মাটিতে দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
রাজধানী কাম্পালা দুর্গাপুজোর প্রধান কেন্দ্র। সাধারণত কাম্পালার হিন্দু মন্দির বা কমিউনিটি হলগুলোতে এই উৎসবের আয়োজন হয়। এখানে প্রতিমা নির্মাণের জন্য ভারত থেকে শিল্পী আনা হয় না; বরং স্থানীয়ভাবে কাঠামো তৈরি করে কাপড়, রঙ ও সাজসজ্জা দিয়ে দেবীর প্রতীকী রূপ নির্মাণ করা হয়। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চণ্ডীপাঠ, পুষ্পাঞ্জলি, ভোগ বিতরণ, সন্ধিপুজো—সব আচার যত্নসহকারে পালন করা হয়। যেহেতু প্রবাসে উপকরণ সংগ্রহ কঠিন, তাই অনেক কিছুই বিকল্প উপায়ে প্রস্তুত করতে হয়; যেমন ফুলের জন্য স্থানীয় বাজারের গাঁদা বা গোলাপ ব্যবহার, কিংবা ভোগে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সবজি অন্তর্ভুক্ত করা।
উগান্ডার দুর্গাপুজো শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং প্রবাসী সমাজের এক বড় সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। বাঙালি পরিবারের পাশাপাশি ভারতীয় অন্যান্য রাজ্যের মানুষ, বাংলাদেশি প্রবাসী, এমনকি কিছু উগান্ডিয়ান বন্ধুরাও এই উৎসবে যোগ দেন। ভোগে পরিবেশিত হয় খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি ও পায়েস, যা বাঙালি স্বাদের আসল অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। অনেক সময় আফ্রিকান রান্নার স্বাদও এই খাবারে মিশে যায়—যেমন স্থানীয় মরিচ বা কাসাভা সংযোজন।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ। বাচ্চারা নাচ, গান, আবৃত্তি পরিবেশন করে, বড়রা নাটক বা কীর্তন করে, আর কখনও কখনও বলিউডের জনপ্রিয় গানও শোনা যায়। এর মাধ্যমে ছোট প্রজন্মের কাছে বাংলার সংস্কৃতি পৌঁছে যায়, আর প্রবাসের মাটিতেও তারা নিজেদের শিকড়ের সঙ্গে পরিচিত হয়।
দশমীর দিন সিঁদুর খেলা এবং প্রতিমা বিসর্জন প্রবাসে বিশেষ আবেগের মুহূর্ত। যেহেতু বড় নদী বা জলাশয় সহজলভ্য নয়, বিসর্জন সাধারণত প্রতীকীভাবে করা হয়—মাটিতে প্রতিমা পুঁতে রাখা বা নির্দিষ্ট স্থানে প্রতীকী বিসর্জন দেওয়া হয়। তবুও সেই বিদায়ের বেদনা, মাতৃভূমির স্মৃতি আর পরের বছরের অপেক্ষা—সবই প্রবাসী হৃদয়ে একইভাবে জাগ্রত হয়।
উগান্ডার দুর্গাপুজো একদিকে যেমন ধর্মীয় আচার পালন, অন্যদিকে এটি প্রবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার দৃঢ় প্রয়াস। দূর আফ্রিকার মাটিতে থেকেও এই উৎসব প্রমাণ করে যে দুর্গাপুজো কেবল ভৌগোলিক সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এক আবেগ, এক ঐতিহ্য, যা যেখানেই বাঙালি থাকবে, সেখানেই নতুন করে জীবন পায়।
ছবি: সংগৃহীত