পিয়া রায়
তানজানিয়ায় দুর্গাপুজো উদযাপন মূলত ভারতীয় ও বাঙালি প্রবাসী সমাজের ঐতিহ্যবাহী উদ্যোগের ফল। পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটি তার সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত হলেও, এখানে বসবাসরত প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে বাঙালিদের একটি ছোট কিন্তু সক্রিয় অংশ রয়েছে। ১৯শ শতকের শেষ ভাগ থেকে ভারতীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা পূর্ব আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষত জানজিবার ও দার এস সালামে বসতি স্থাপন করেন। বাণিজ্য, রেলপথ নির্মাণ ও নানা ব্যবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁরা তানজানিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হন। এই প্রবাসী সমাজের মধ্যেই দুর্গাপুজো এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
দার এস সালাম, তানজানিয়ার বৃহত্তম শহর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র, দুর্গাপুজোর প্রধান আয়োজনস্থল। এখানে পূজার আয়োজন করে স্থানীয় বাঙালি ও ভারতীয় সংগঠন, প্রায়শই হিন্দু মন্দির বা কমিউনিটি হলকে কেন্দ্র করে। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চণ্ডীপাঠ, পুষ্পাঞ্জলি, ভোগ পরিবেশন, আরতী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিমা নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভারত থেকে বা কেনিয়া থেকে আনা মূর্তি ব্যবহার করা হয়, আবার কখনও স্থানীয় শিল্পীরা কাঠামো বানিয়ে কাপড়, কাগজ ও রঙ দিয়ে দেবীর প্রতীকী রূপ সৃষ্টি করেন। পূজার উপকরণ সংগ্রহও প্রবাসে একটি চ্যালেঞ্জ, তাই স্থানীয় ফুল, ফল ও শস্য দিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ করা হয়।
তানজানিয়ার দুর্গাপুজো প্রবাসী সমাজের জন্য শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এক মিলনক্ষেত্র। এখানে বাঙালি, মারোয়ারি, গুজরাটি, তামিল, তেলেগু প্রভৃতি ভারতীয় সম্প্রদায় একত্রিত হন। অনেকে তাঁদের তানজানিয়ান বন্ধুদেরও আমন্ত্রণ জানান, ফলে এটি আন্তঃসাংস্কৃতিক বন্ধনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে। ভোগের মেনুতে সাধারণত বাঙালি রীতি মেনে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েস থাকে, তবে মাঝে মাঝে স্থানীয় রান্নার স্বাদও যুক্ত হয়—যেমন নারকেল দুধে রান্না করা সবজি বা স্থানীয় মশলার ব্যবহার।
সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুদের নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, নাটক এবং মাঝে মাঝে বলিউড গানের পরিবেশনা দেখা যায়। এর মাধ্যমে ছোট প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। পূজার সময় অনেকেই শাড়ি, পাঞ্জাবি বা কুর্তা পরে আসেন, যা বিদেশের মাটিতেও বাঙালিয়ানার আবহ তৈরি করে।
দশমীর দিন সিঁদুর খেলা ও প্রতিমা বিসর্জনও এখানে পালন করা হয়, যদিও সমুদ্রতীরবর্তী শহর হওয়ায় অনেক সময় ছোট নৌকায় করে প্রতিমা নিয়ে সমুদ্রে প্রতীকী বিসর্জন দেওয়া হয়। তবে পরিবেশগত কারণে অনেক ক্ষেত্রে বিসর্জন মাটিতে পুঁতে রাখা বা প্রতিমার অংশ পুনর্ব্যবহার করাও প্রচলিত।
তানজানিয়ায় দুর্গাপুজো প্রমাণ করে, দূর আফ্রিকার এক কোণে থেকেও বাঙালির উৎসব চেতনা নিভে যায় না। বরং প্রবাসের মাটিতে এটি এক সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করে—যেখানে শিকড়ের টান, ঐতিহ্যের গর্ব এবং নতুন প্রজন্মকে সংস্কৃতির আলোয় আলোকিত করার প্রতিজ্ঞা একই মঞ্চে মিলিত হয়। এই পূজা কেবল দেবীর আরাধনা নয়, বরং এটি প্রবাসী বাঙালির আত্মপরিচয় রক্ষার এক দৃঢ় অঙ্গীকার।
ছবি: সংগৃহীত