হাঙ্গেরি, মধ্য ইউরোপের একটি সুন্দর দেশ, যার ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইউরোপীয় সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মূলত ক্যাথলিক খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে ভারতীয় ও বাঙালি প্রবাসীর সংখ্যা খুব বেশি না হলেও, তাঁদের উদ্যোগে দুর্গাপুজো আজ সেখানে এক বিশেষ সাংস্কৃতিক আয়োজন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রবাসী জীবনের ব্যস্ততার মধ্যেও যে শিকড়ের টান মানুষকে নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত রাখে, হাঙ্গেরির দুর্গাপুজো তারই এক উজ্জ্বল প্রমাণ।
বুদাপেস্ট, যা হাঙ্গেরির রাজধানী এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সেখানে দুর্গাপুজোর সূচনা হয় প্রায় এক দশক আগে। মূলত ভারতীয় দূতাবাস এবং কিছু বাঙালি সংগঠনের উদ্যোগেই প্রথম পুজোর আয়োজন করা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন আইটি পেশাজীবী, গবেষক, আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মী, শিক্ষার্থী এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত বাঙালিরা। পূজার আয়োজনে অর্থনৈতিক এবং লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ থাকলেও, আন্তরিকতার অভাব থাকে না। সাধারণত পুজো অনুষ্ঠিত হয় কমিউনিটি সেন্টার, সাংস্কৃতিক হল বা কখনও কখনও ভারতীয় দূতাবাসের সহযোগিতায়। প্রতিমা কলকাতা বা ঢাকার মৃৎশিল্পীদের কাছ থেকে আনানো সম্ভব না হলে স্থানীয় কারিগরদের সহায়তায় তৈরি ফাইবারগ্লাস বা থার্মোকলের মডেল ব্যবহার করা হয়।
দুর্গাপুজোতে রীতি অনুযায়ী বোধন, অঞ্জলি, চণ্ডীপাঠ, আরতি ও সন্ধিপুজো হয়। যদিও সময় এবং পরিবেশের সীমাবদ্ধতার কারণে সব আচার সম্পূর্ণভাবে পালন করা যায় না, তবুও মূল ভাবধারা অক্ষুণ্ণ থাকে। ঢাক, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি—এই শব্দগুলো যখন বিদেশের মাটিতে শোনা যায়, তখন প্রবাসীরা অনুভব করেন এক অনন্য আবেগ। শুধু ধর্মীয় আচার নয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও এই পূজোর একটি বড় অংশ। আবৃত্তি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক গান, নাটক—সবই থাকে আনন্দের সঙ্গে। পুজোর শেষে পরিবেশিত হয় খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি ও পায়েস, যা মুহূর্তেই মনে করিয়ে দেয় শারদীয় উৎসবের মাতৃভূমির গন্ধ।
হাঙ্গেরিতে দুর্গাপুজো একটি সাংস্কৃতিক সংলাপের ক্ষেত্রও তৈরি করেছে। স্থানীয় হাঙ্গেরিয়ান নাগরিকরা, যারা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী, অনেক সময় পুজোতে অংশগ্রহণ করেন। এর ফলে তৈরি হয় আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়, যা উভয় সমাজের সম্পর্ককে দৃঢ় করে। এভাবে পুজো হয়ে ওঠে শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং প্রবাসী বাঙালিদের জন্য শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখার এক সেতুবন্ধন।
অতএব, হাঙ্গেরির দুর্গাপুজো প্রমাণ করে যে উৎসবের প্রাণশক্তি ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নয়। ভাষা, দেশ ও সংস্কৃতির পার্থক্য সত্ত্বেও, বাঙালির শারদীয় উৎসব তার ঐতিহ্য, আবেগ ও আনন্দের মাধুর্য নিয়ে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে সমানভাবে প্রস্ফুটিত হতে পারে। এই পুজো বাঙালির জন্য শুধু দেবী আরাধনা নয়, এটি হলো ঐক্যের প্রতীক, শিকড়ের প্রতি টান এবং এক অদম্য সাংস্কৃতিক সত্তার বহিঃপ্রকাশ।
ছবি: সংগৃহীত