পিয়া রায়
ক্রোয়েশিয়ার মতো একটি ইউরোপীয় রাষ্ট্রে দুর্গাপুজোর মতো বাঙালি হিন্দু ধর্মীয় উৎসবের আয়োজন শুনতে যতটা অবাক লাগে, বাস্তবে এটি ততটাই গভীর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করে। ক্রোয়েশিয়া মূলত একটি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যেখানে ক্যাথলিক রীতিনীতির গভীর শিকড় রয়েছে। তবুও, গত এক দশকে ইউরোপে প্রবাসী বাঙালিদের সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে ক্রোয়েশিয়াও বাদ যায়নি। বিশেষত জাগরেব ও স্প্লিট শহরে কর্মসূত্রে বসবাসকারী ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালিরা নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে দুর্গাপুজোর মতো উৎসব আয়োজনের দিকে ধাবিত হয়েছেন।
ক্রোয়েশিয়ায় দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছে মূলত ভারতীয় দূতাবাস ও কিছু প্রবাসী বাঙালির মিলিত প্রচেষ্টায়। যদিও কলকাতার মতো জাঁকজমকপূর্ণ প্যান্ডেল বা প্রতিমা এখানে সম্ভব নয়, তবে উৎসাহের কোনো ঘাটতি নেই। পুজো সাধারণত একটি কমিউনিটি হল বা কালচারাল সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিমা প্রায়শই কাগজ, কাঠ বা ফাইবারে তৈরি স্থানীয়ভাবে হস্তনির্মিত হয়, যেটি কল্পনার রূপ ধারণ করে। কিছু বছর ভার্চুয়াল প্রতিমা বা আলোকচিত্র দিয়েই পুজোর আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে, যা এক অভিনব উদ্যোগ।
পূজার দিনগুলোতে বাঙালি পরিবারগুলোর মধ্যে এক আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হয়। সকালের অঞ্জলি, চণ্ডীপাঠ, সন্ধ্যার ধুনুচি নাচ ও আরতি—সবকিছু যেন একটুকরো পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশকে ক্রোয়েশিয়ার মাটিতে এনে দেয়। পুজোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে সন্ধ্যার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে প্রবাসী শিশু-কিশোরেরা আবৃত্তি, গান, নৃত্য পরিবেশন করে। কখনও কখনও স্থানীয় হাঙ্গেরিয়ান বা ক্রোয়াট নাগরিকরাও আমন্ত্রিত হয়ে এই সংস্কৃতি উপভোগ করেন, যা একটি আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্র তৈরি করে।
খাবার-দাবারেও বাঙালিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, পায়েস প্রভৃতি তৈরি হয় প্রবাসী রাঁধুনিদের হাতে। অনেক সময় ভারতীয় রেস্টুরেন্ট বা দূতাবাস সহযোগিতা করে খাবারের ব্যবস্থায়। তবে সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হলো সেই মিলনমেলা—যেখানে প্রবাসী বাঙালিরা শুধুই ধর্ম পালন করেন না, বরং নিজেদের শিকড়, সংস্কৃতি ও ভাষার সঙ্গে এক গভীর মানসিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেন।
দুর্গাপুজো এখন ক্রোয়েশিয়ার মতো দেশে কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার প্রতীক। এটি প্রমাণ করে, বাংলা সংস্কৃতি যত দূরেই ছড়িয়ে পড়ুক না কেন, তার প্রাণশক্তি কখনও নিঃশেষ হয় না। পুজোর চারটি দিন যেন এক চিত্রহীন মানচিত্রে বাঙালির আত্মপরিচয়ের জ্বলন্ত আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে। তাই এই উৎসব শুধু প্রার্থনার সময় নয়, বরং তা এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আবেগঘন পুনর্মিলনের মুহূর্ত যা ক্রোয়েশিয়ার প্রবাসী বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ছবি: সংগৃহীত