পিয়া রায়
লুক্সেমবার্গে দুর্গাপুজো— ইউরোপের মধ্যভাগে স্থাপিত ক্ষুদ্র অথচ সমৃদ্ধ দেশটির বুকে এক অভিনব সাংস্কৃতিক উৎসব। লুক্সেমবার্গ একটি খ্রিস্টান প্রধান রাষ্ট্র, যেখানে ক্যাথলিক ধর্মাচরণের গভীর ঐতিহ্য রয়েছে। তবে গত কয়েক দশকে এখানে বসবাসকারী ভারতীয় ও বাংলাদেশি প্রবাসীদের উপস্থিতি যেমন বেড়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মাচরণের প্রয়াস। সেই সূত্রেই শুরু হয়েছে দুর্গাপুজো, যা আজ শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক মিলনের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
লুক্সেমবার্গে দুর্গাপুজোর সূচনা ঘটে ২০১০-এর দশকের প্রথম দিকে, মূলত ভারতীয় ও বাংলাদেশি বাঙালি সম্প্রদায়ের হাত ধরে। তারা সংখ্যায় অল্প হলেও, নিজেদের শিকড় ধরে রাখার তাগিদে প্রতিবছর শরৎকালে মা দুর্গার আরাধনায় একত্রিত হন। পুজোর স্থান সাধারণত নির্ধারিত হয় কমিউনিটি সেন্টার বা ভারতীয় দূতাবাস অনুমোদিত কোনো মিলনায়তনে। কাঠ বা ফাইবারে তৈরি প্রতিমা কলকাতা বা ঢাকার মতো শিল্পিত না হলেও, তার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব কোনও অংশে কম নয়। অনেকে ভারতে নির্মিত প্রতিমা এনে পুজো করেন, আবার কেউ কেউ স্থানীয় শিল্পীদের সাহায্যে প্রতিমা নির্মাণ করেন।
দুর্গাপুজোর মূল আকর্ষণ শুধুমাত্র পুজোই নয়—বরং প্রবাসী বাঙালিদের একত্রিত করে একটি বৃহত্তর সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করা। সকালে পুষ্পাঞ্জলি, সন্ধ্যায় আরতি, ধুনুচি নাচ, ও সন্ধ্যার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—এই চারদিন যেন লুক্সেমবার্গে বসেই কলকাতা বা ঢাকার ঘ্রাণ এনে দেয়। পুজো উপলক্ষে আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য পরিবেশন করেন প্রবাসী শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীরা। এ ছাড়াও স্থানীয় ইউরোপীয় বন্ধুরাও অনুষ্ঠানে যোগ দেন, যা আন্তঃসাংস্কৃতিক বন্ধনকে দৃঢ় করে।
খাবারের আয়োজনেও বাঙালিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। খিচুড়ি, লাবড়া, পাঁপড়, চাটনি, পায়েস প্রভৃতি পরিবেশন করা হয়, যা বাঙালি রান্নার ঘ্রাণে প্রবাসেও এক বিশেষ আবহ তৈরি করে। কখনও ভারতীয় রেস্তোরাঁ সহযোগিতা করে এই উৎসবে খাবার সরবরাহ করে, কখনও প্রবাসী মহিলারাই এগিয়ে আসেন রান্নার দায়িত্বে।
লুক্সেমবার্গে দুর্গাপুজো কেবল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তা এক মানসিক আশ্রয়—এক আবেগঘন মিলনক্ষেত্র, যেখানে বাঙালিরা নিজেদের সংস্কৃতি, স্মৃতি ও আত্মপরিচয়কে জড়িয়ে ধরেন। ইউরোপের ব্যস্ত জীবনের মাঝে এই চারদিন যেন তাদের জীবনে উৎসবের রঙ ছড়িয়ে দেয়। ছোট পরিসরের মধ্যেই, যথাসম্ভব নিয়ম-রীতি মেনে, মা দুর্গার পুজো করে তাঁরা শিকড়ে ফিরে যাওয়ার এক সেতু নির্মাণ করেন।
এইভাবেই লুক্সেমবার্গের মতো ক্ষুদ্র ইউরোপীয় দেশের এক কোণে দুর্গাপুজো আজ বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, যা মনে করিয়ে দেয়—ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির টান কখনও মুছে যায় না, তা বরং আরও দৃঢ় হয় দূরত্বে, প্রবাসে, ভালোবাসায়।
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব দরবারে দুর্গাপুজো: লুক্সেমবার্গ
Thursday, October 02, 2025


