পিয়া রায়
ভৌগোলিকভাবে দূর, সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন হলেও, প্রবাসী বাঙালিদের আন্তরিকতায় গ্রীসের মাটিতেও আজ মা দুর্গার আবাহন ঘটে। ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত এই দেশটি মূলত গ্রীক অর্থোডক্স খ্রিস্টান প্রধান হলেও, এখানে বসবাসরত ভারতীয়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের প্রবাসী বাঙালিরা প্রতি বছর দুর্গাপুজো পালন করে আসছেন নিঃশব্দে, কিন্তু গভীর আবেগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে। এই উৎসব শুধু এক ধর্মীয় অনুশাসন নয়, বরং প্রবাসে শিকড়কে জিইয়ে রাখার এক ঐকান্তিক প্রয়াস।
গ্রিসে দুর্গাপুজোর সূচনা মূলত ২০০০ সালের পর থেকে চোখে পড়ার মতো হয়ে ওঠে। গ্রিসে বসবাসকারী ভারতীয় অভিবাসীদের মধ্যে বাঙালিদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও, তাঁরা কলকাতার দুর্গাপুজোর ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে প্রবাসেও এই উৎসব উদযাপনে উদ্যোগী হন। বিশেষ করে অ্যাথেন্স, পিরেয়াস, থেসালোনিকি-র মতো শহরগুলিতে দুর্গাপুজোর আয়োজন দেখা যায়। এখানে সাধারণত কোনও ভারতীয় সংগঠন, কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন বা নির্দিষ্ট কমিউনিটি সেন্টার এই পুজোর আয়োজন করে। ভারতীয় দূতাবাসও অনেক সময় এই আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতায় সহায়তা করে।
পুজোর প্রতিমা তৈরি করা হয় স্থানীয়ভাবে, কখনও কাঠ, পলিস্টার বা ফাইবারগ্লাস ব্যবহার করে। অনেকে কলকাতা থেকে প্রতিমার ছোট সংস্করণ আনিয়ে থাকেন। পুজোর আয়োজন ছোট হলেও, দেবী আরাধনায় কোনো ত্রুটি রাখেন না আয়োজকেরা। পুষ্পাঞ্জলি, সন্ধিপুজো, আরতি, ধুনুচি নাচ—সবই হয় যথাসম্ভব ঘরোয়া অথচ পরিপাটি আয়োজনে। ভোগ হিসেবে পরিবেশিত হয় খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েস, যা অনেক সময় প্রবাসী মহিলারাই রান্না করে থাকেন।
দুর্গাপুজো উপলক্ষে এখানে প্রবাসীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়—নাটক, আবৃত্তি, নৃত্য, সংগীত পরিবেশন করেন প্রবাসী বাঙালি শিশুরা ও তরুণ-তরুণীরা। এই অনুষ্ঠানগুলোতে স্থানীয় গ্রীক নাগরিকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়, ফলে আন্তঃসাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ঘটে। অনেক গ্রীক নাগরিক উৎসুক হয়ে এই পুজোতে অংশ নেন এবং ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রবাসে এই দুর্গাপুজো বাঙালিদের একত্রিত হওয়ার অন্যতম উপলক্ষ। বছরের এই কয়েকটা দিন যেন অ্যাথেন্সের একপ্রান্তে বয়ে যায় গঙ্গার ঢেউ। বিদেশ বিভুঁইয়ে থেকেও এই পুজো মানুষকে শিকড়ের টানে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। অনেকে বলেন, প্রবাসে দুর্গাপুজো আসলে শুধুমাত্র দেবীর আরাধনা নয়, বরং বাঙালিত্বের মহোৎসব।
গ্রিসে দুর্গাপুজোর এই চর্চা প্রমাণ করে—ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা কোনও ভূগোলের সীমায় বাঁধা পড়ে না। বরং মানুষ যেখানেই থাকুক, নিজের শিকড়, ঐতিহ্য আর চেতনার সঙ্গে সে যুক্ত থাকে উৎসবের মধ্য দিয়ে। গ্রিসের প্রবাসী বাঙালিদের দুর্গাপুজো সেই সংস্কৃতিরই এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
ছবি: সংগৃহীত