পিয়া রায়
ইসরায়েলের মতো একটি মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রে দুর্গাপুজোর আয়োজন, প্রথম শ্রুতিতে অবাক লাগলেও, বাস্তবে এটি প্রবাসী ভারতীয় বাঙালিদের এক আবেগময় সাংস্কৃতিক চর্চা। মূলত হিব্রু ধর্মবিশ্বাসে গড়া এই ইহুদি রাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় অভিবাসীরা, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাঙালি পরিবাররা, প্রতিবছরই সনাতনী আচার-অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে দুর্গাপুজো পালন করে আসছেন। এ পুজো নিছক ধর্মীয় নয়, বরং তাদের শিকড়ের টান, পরিচয়ের অন্বেষণ, এবং প্রজন্মান্তরের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার এক অবিচ্ছেদ্য প্রয়াস।
ইসরায়েলে দুর্গাপুজোর সূচনা মূলত ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে হয়, যখন হায়ফা, তেল আভিভ, ও জেরুজালেম-সহ বিভিন্ন শহরে ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অধিকাংশ ভারতীয়ই এখানে তথ্যপ্রযুক্তি, চিকিৎসা, ও গবেষণা ক্ষেত্রে কর্মরত; অনেকেই ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যুক্ত। তাদের মধ্যে বাঙালিরা সংখ্যায় কম হলেও উৎসব পালনে তাদের আগ্রহ প্রবল। প্রতি বছর শরৎকালে, শারদীয়া দুর্গোৎসবের সময় তারা দলবদ্ধভাবে দুর্গাপুজোর আয়োজন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুজো আয়োজন হয় কোনো কমিউনিটি হলে, কখনো কখনো কারও ব্যক্তিগত বাসভবনেই।
প্রতিমা সাধারণত কলকাতা বা দিল্লি থেকে ছোট করে বানিয়ে পাঠানো হয়, অনেক সময় কাঠ, কাগজ বা ফাইবার দিয়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয় প্রতীকী রূপ। পুজোর সমস্ত আচার—নিয়মমাফিক ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত অঞ্জলি, সন্ধিপুজো, আরতি, ধুনুচি নৃত্য—সবই অনুষ্ঠিত হয় যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে। যেহেতু মন্ত্রোচ্চারণের জন্য কোনও পুরোহিত সবসময় পাওয়া যায় না, অনেক সময় আধুনিক পদ্ধতিতে অডিও বা ভিডিও রেকর্ডিং-এর মাধ্যমে মন্ত্র পাঠ করা হয় বা স্বেচ্ছাসেবকরাই দায়িত্ব নেন।
ভোগ রান্না হয় ঘরোয়া ভাবে—খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েস, চাটনি, বেগুনি—সবই অভিজাত রন্ধনপ্রণালিতে প্রবাসী নারীদের হাতে তৈরি। পুজোর শেষে এসব খাওয়া হয় সবার সঙ্গে ভাগ করে, যেন সে-ই এক মুহূর্তের ‘নতুন কলকাতা’। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও দুর্গাপুজোর বড় আকর্ষণ, যেখানে গান, কবিতা আবৃত্তি, নাচ, ছোট নাটক পরিবেশিত হয়। শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা এতে অংশ নিয়ে একদিকে যেমন নিজেদের বাঙালিত্বের সঙ্গে পরিচিত হয়, অন্যদিকে অন্য সংস্কৃতির মানুষের কাছেও বাঙালি ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
ইসরায়েলে দুর্গাপুজোর এই আয়োজন শুধুমাত্র ধর্মীয়তা নয়, বরং আবেগ, ঐতিহ্য, ও আত্মপরিচয়ের মিলনস্থল। প্রবাসের নিষ্প্রাণ, কর্মব্যস্ত জীবনে এই পুজো কয়েকদিনের জন্য এনে দেয় আত্মিক প্রশান্তি, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, ও শিকড়ের ছোঁয়া। এমনকি বহু ইসরায়েলি নাগরিকও কৌতূহলী হয়ে এই পুজোয় অংশ নেন এবং ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহ দেখান। তাই বলা যায়, ইসরায়েলের দুর্গাপুজো কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি এক বহুসংস্কৃতির সেতুবন্ধন, যা প্রমাণ করে—ভাষা, ধর্ম, জাতির পার্থক্য থাকলেও উৎসবের হৃদয় এক ও অভিন্ন।
ছবি: সংগৃহীত