পিয়া রায়
তুরস্কের মতো একটি ইসলামপ্রধান রাষ্ট্রে দুর্গাপুজোর আয়োজন শুনতে বিস্ময়কর হলেও, বাস্তবে এটি প্রবাসী ভারতীয়, বিশেষত বাঙালিদের সংস্কৃতি ও আবেগের এক উজ্জ্বল প্রকাশ। ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত তুরস্কে ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, তবে বিগত এক দশকে বাণিজ্য, শিক্ষা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির ফলে এখানে ভারতীয় সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ধীরে ধীরে বাড়ছে। সেই সঙ্গেই বাড়ছে উৎসবের আবহ, যার মধ্যে অন্যতম দুর্গাপুজো।
তুরস্কে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছে মূলত ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার মতো শহরে। এখানকার পুজোর আয়োজন কোনো মণ্ডপে নয়, বরং ছোট আকারের কমিউনিটি হলে বা হোটেলের কনফারেন্স রুমে। পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা হন প্রবাসী ভারতীয় ও বাংলাদেশি পরিবাররা, যারা স্থানীয় ভারতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ভারতীয় দূতাবাসের সহযোগিতা পান। তুরস্কে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের কিছু আইনগত বিধিনিষেধ থাকলেও, প্রবাসীরা ব্যক্তিগত বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নাম করে এই আয়োজন সম্পন্ন করেন।
প্রতিমা সাধারণত কলকাতা বা দিল্লি থেকে আনা সম্ভব হয় না। তাই স্থানীয় শিল্পীদের সহায়তায় থার্মোকল, ফাইবারগ্লাস বা মুদ্রিত চিত্র ব্যবহার করে দেবীর প্রতীকী রূপ নির্মাণ করা হয়। কেউ কেউ ডিজিটাল প্রতিমার সামনে পুজো করেন। পূজার রীতি যথাসম্ভব পালন করা হয়—ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত অঞ্জলি, চণ্ডীপাঠ, সন্ধিপুজো ও আরতি হয়। পুরোহিত না থাকলে প্রবাসী কোনো সদস্য মন্ত্র পাঠ করেন বা রেকর্ড করা চণ্ডীপাঠ বাজানো হয়।
খাবারের আয়োজন এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি, পায়েস—সবই প্রবাসী বাঙালিদের হাতে রান্না করা হয়। ভোগের স্বাদে কলকাতার দুর্গাপুজোর ঘ্রাণ এনে দেয় প্রবাসী জীবনে। এছাড়াও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়—গান, আবৃত্তি, নাচ এবং ছোট নাটকের মাধ্যমে এই উৎসব পরিণত হয় সামাজিক মিলনমেলায়। প্রবাসী শিশুদের জন্য এটি শিকড়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম।
তুর্কি নাগরিকরাও অনেক সময় এই পুজোয় আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। তারা ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র্য জানতে আগ্রহী হয় এবং অনেকেই এ অভিজ্ঞতাকে অনন্য বলে মনে করেন। ফলে দুর্গাপুজো এখানে শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসবের সীমায় আবদ্ধ থাকে না; এটি হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন, যেখানে ভারতীয় ঐতিহ্য ও তুর্কি সৌহার্দ্য মিলেমিশে যায়।
তুরস্কের দুর্গাপুজো তাই প্রমাণ করে—উৎসব ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নয়। প্রবাসের ব্যস্ততা, ভাষা-সংস্কৃতির পার্থক্য সত্ত্বেও বাঙালি তার শিকড়কে আঁকড়ে ধরে রাখে আবেগের শক্তিতে। ইস্তাম্বুলের কোনো প্রবাসী পরিবারের ঘরে ধূপের গন্ধে, ঢাকের তালে, কিংবা ডিজিটাল চণ্ডীপাঠের সুরে আজও জেগে ওঠে মাতৃভূমির শারদীয় অনুভূতি। এই আয়োজন শুধু দেবী আরাধনা নয়, বরং আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্যের দীপ্ত ঘোষণা।
বিশ্ব দরবারে দুর্গাপুজো: তুরস্ক
Friday, August 08, 2025