পিয়া রায়
কেনিয়ায় দুর্গাপুজো প্রবাসী ভারতীয় সম্প্রদায়ের দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পূর্ব আফ্রিকার এই দেশে ভারতীয়দের আগমন শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, মূলত রেলপথ নির্মাণ ও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। সেই সময়ে গুজরাটি, পাঞ্জাবি, তামিল ও বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা কেনিয়ায় বসবাস শুরু করেন। যদিও প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, তবুও তাঁদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় শিকড়কে ধরে রাখার প্রচেষ্টা অবিচল রয়েছে, যার অন্যতম প্রমাণ দুর্গাপুজোর আয়োজন।
নাইরোবি ও মোমবাসা শহর দুটি কেনিয়ায় দুর্গাপুজোর মূল কেন্দ্র। এখানে ভারতীয় হিন্দু মন্দির ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো, যেমন হিন্দু কাউন্সিল অব কেনিয়া এবং স্থানীয় বঙ্গীয় সমিতি, পুজোর আয়োজনের প্রধান ভূমিকা পালন করে। পুজোর সময় মন্দির প্রাঙ্গণ বা কমিউনিটি হলকে প্যান্ডেলের মতো সাজানো হয়। প্রতিমা আনার ক্ষেত্রে অনেক সময় ভারত থেকে মূর্তি তৈরি করে আনা হয়, আবার কখনও স্থানীয় শিল্পীর তৈরি প্রতিমা ব্যবহৃত হয়। যেখানে প্রতিমা আনা সম্ভব হয় না, সেখানে দেবীর ছবি বা প্রতীকী প্রতিমা দিয়ে পূজার আয়োজন হয়।
দুর্গাপুজো এখানে শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং প্রবাসীদের জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলার এক প্রধান উপলক্ষ। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন অঞ্জলি, চণ্ডীপাঠ, সন্ধিপুজো ও আরতির আয়োজন করা হয়। পুরোহিত না থাকলে, কোনো প্রবাসী সদস্যই পূজার নেতৃত্ব দেন, এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারতে অবস্থানরত পুরোহিতকে অনলাইন সংযোগে যুক্ত করাও এখন আর অস্বাভাবিক নয়। অঞ্জলির পর সকলের জন্য পরিবেশিত হয় ভোগ, যেখানে থাকে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েস এবং কখনও স্থানীয় রান্নার প্রভাবও।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। প্রবাসী শিশু ও তরুণদের জন্য থাকে নাচ, গান, আবৃত্তি এবং নাটক পরিবেশনের সুযোগ। এতে অংশ নিয়ে তারা কেবল আনন্দই পায় না, বরং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও ধর্মীয় ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হয়। প্রবাসে জন্মানো প্রজন্মের কাছে এই পুজোই হয়ে ওঠে মাতৃভূমির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার সেতুবন্ধন।
এছাড়া দুর্গাপুজো কেনিয়ায় আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়েরও একটি মাধ্যম। অনেক স্থানীয় কেনিয়ান, বিশেষত যারা ভারতীয় বংশোদ্ভূত নন, তাঁরাও কৌতূহলবশত বা আমন্ত্রণে এই উৎসবে যোগ দেন। ঢাকের তালে, ধূপের গন্ধে ও ভোগের স্বাদে তারা ভারতীয় সংস্কৃতির অনন্য দিকের স্বাদ পান। এর ফলে স্থানীয় সমাজ ও প্রবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক আরও মজবুত হয়।
কেনিয়ার দুর্গাপুজো হয়তো আকারে কলকাতার মতো নয়, কিন্তু এর আবেগ, আন্তরিকতা এবং ঐতিহ্য ধরে রাখার দৃঢ়তা তুলনাহীন। বিদেশের মাটিতে থেকেও, প্রবাসী বাঙালি ও অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা এই উৎসবের মাধ্যমে নিজেদের পরিচয়কে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেন এবং প্রমাণ করেন যে, দুর্গাপুজো কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি হলো ভালোবাসা, ঐক্য ও শিকড়ের প্রতি গভীর টান।
ছবি: সংগৃহীত