পিয়া রায়
দক্ষিণ আফ্রিকায় দুর্গাপুজো এক অনন্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের প্রতীক, যা ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে ভারতীয় শ্রমিকদের প্রথম আগমন ঘটে এই দেশে, মূলত আখের বাগানে কাজ করার জন্য। তাদের মধ্যে ছিলেন বহু হিন্দু বাঙালি ও অবাঙালি পরিবার, যারা নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে এনেছিলেন। সেই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতায় আজ দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন শহরে দুর্গাপুজোর আয়োজন হয়ে থাকে। যদিও মূলত কলকাতার মতো বিশাল আকারের নয়, তবে এর আবেগ ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনস্বীকার্য।
ডারবান, জোহানেসবার্গ, কেপটাউন ও প্রিটোরিয়ার মতো শহরে দুর্গাপুজোর আয়োজন তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে ডারবান, যেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনসংখ্যা বেশি, সেখানে হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং মন্দিরভিত্তিক পূজার প্রচলন বহু পুরনো। এখানে দুর্গাপুজো সাধারণত হিন্দু সোসাইটি, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বা স্থানীয় মন্দিরের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। পুজোর মূর্তি ভারতে তৈরি করিয়ে আনা হয় কিংবা স্থানীয় শিল্পীদের দ্বারা নির্মিত হয়। প্রতিমা স্থাপন, চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলি, আরতি, আর ভোগ পরিবেশনের মাধ্যমে পূজার পূর্ণাঙ্গ আয়োজন সম্পন্ন হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় দুর্গাপুজোর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র। প্রবাসী বাঙালিদের পাশাপাশি এখানে তামিল, তেলেগু এবং গুজরাটি হিন্দুরাও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। এমনকি বহু দক্ষিণ আফ্রিকান, যারা ভারতীয় বংশোদ্ভূত নন, তারাও এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন কৌতূহলবশত এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য। ফলে পুজো শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি হয়ে ওঠে বহুজাতিক ও বহুসাংস্কৃতিক মিলনমেলা।
খাবারের আয়োজনও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভোগের মেনুতে থাকে খিচুড়ি, সবজি, লাবড়া, চাটনি, পায়েসসহ দক্ষিণ ভারতীয় কিছু পদ, যা অংশগ্রহণকারীদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত উপকরণ দিয়েই প্রবাসী রান্নাঘরে তৈরি হয় এই খাবার, যা দূর দেশের মাটিতে বাঙালি ও ভারতীয় স্বাদের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। স্থানীয় শিল্পীরা নাচ, গান, আবৃত্তি এবং নাটক পরিবেশন করেন। শিশুদের জন্য থাকে বিশেষ আয়োজন, যাতে তারা বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং দেবী মহাত্ম্যের কাহিনি সম্পর্কে জানতে পারে। এটি প্রবাসে জন্মানো প্রজন্মের মধ্যে শিকড়ের সঙ্গে এক আত্মিক বন্ধন তৈরির অন্যতম মাধ্যম।
দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্গাপুজো তাই কেবল একটি উৎসব নয়—এটি প্রবাসী ভারতীয়দের পরিচয়, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক। এই আয়োজনের মাধ্যমে তারা নিজেদের ধর্মীয় অনুশাসন বজায় রাখার পাশাপাশি, স্থানীয় সমাজের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ঢাকের তালে, ধূপের গন্ধে আর ভোগের স্বাদে, হাজার মাইল দূরের দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতেও মাতৃভূমির শারদীয় আবেগ জীবন্ত হয়ে ওঠে।
ছবি: সংগৃহীত