পিয়া রায়
অস্ট্রেলিয়ায় দুর্গাপুজো এখন প্রবাসী বাঙালিদের বার্ষিক উৎসব ক্যালেন্ডারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশাল ভৌগোলিক পরিসর জুড়ে বিস্তৃত এই দেশে বসবাসরত ভারতীয় প্রবাসী সম্প্রদায়, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাঙালিরা, পূজাকে ঘিরে তৈরি করেছেন এক প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক আবহ। ১৯৭০-এর দশকে যখন প্রথম দিকে বাঙালি পরিবারগুলি পড়াশোনা, চাকরি ও ব্যবসার উদ্দেশ্যে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান, তখন পূজা ছিল ঘরোয়া আয়োজন—কয়েকটি পরিবার মিলে বাড়ির বসার ঘরে প্রতিমার ছবি সাজিয়ে চণ্ডীপাঠ করতেন, রান্না করতেন ভোগ, আর সারা দিনটি কাটত আড্ডা ও গান-গল্পে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসী বাঙালির সংখ্যা বাড়তে থাকে, এবং সেইসঙ্গে দুর্গাপুজোর আয়োজনও পায় বৃহত্তর রূপ।
আজ সিডনি, মেলবোর্ন, ব্রিসবেন, পার্থ, অ্যাডিলেডসহ প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন বাঙালি সাংস্কৃতিক সংগঠন ও পূজা কমিটি কয়েক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে। প্রতিমা অনেক সময় কলকাতা বা কুমোরটুলি থেকে বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে আনা হয়, আবার কখনও স্থানীয় শিল্পীর হাতে মূর্তি তৈরি হয়। পূজার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয় স্কুল অডিটোরিয়াম, কমিউনিটি সেন্টার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলরুম, যা কয়েক দিনের জন্য রূপ নেয় ছোট্ট এক টুকরো ‘বাংলা’তে। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চলে পূজা, অঞ্জলি, ভোগ পরিবেশন ও আরতি, আর সন্ধ্যায় থাকে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তি এবং মাঝে মাঝে প্রবাসী ও আমন্ত্রিত শিল্পীদের পরিবেশনা।
ভোগের মেনুতেও রয়েছে বাঙালিয়ানা—খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েস, সঙ্গে মাঝে মাঝে ফিউশন স্বাদ, যেমন নারকেলের ঘ্রাণমাখা সবজি বা অস্ট্রেলিয়ান ফল দিয়ে তৈরি ডেজার্ট। পূজাকে ঘিরে বাজারও জমজমাট হয়ে ওঠে—সারির পর সারি শাড়ি, পাঞ্জাবি, গয়না, মিষ্টি ও বইয়ের স্টল বসে, যা অনেকের জন্য বাড়তি আকর্ষণ। এখানে শুধু বাঙালি নয়, অন্যান্য ভারতীয় সম্প্রদায় এবং স্থানীয় অস্ট্রেলিয়ানরাও অংশ নেন, ফলে দুর্গাপুজো পরিণত হয়েছে এক আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়ের উৎসবে।
অস্ট্রেলিয়ার দুর্গাপুজোর আরেকটি বিশেষ দিক হলো প্রবাসী বাঙালিদের পারস্পরিক সম্পর্কের দৃঢ়তা। সারা বছর ব্যস্ত জীবনে অনেকের দেখা না হলেও পূজার সময় প্রায় সবাই উপস্থিত হন, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন, নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন বাংলা গান, কবিতা ও রীতিনীতির। শিশু ও তরুণদের জন্য থাকে বিশেষ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, যা তাদের ভাষা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত রাখে।
দশমীর দিন সিঁদুর খেলা, ঢাকের তালে নাচ এবং প্রতিমা বিসর্জনের প্রতীকী আয়োজন হয়। যেহেতু সমুদ্রে বা নদীতে বিসর্জন দেওয়া সম্ভব হয় না, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিমা পুনর্ব্যবহার বা সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে পরিবেশ সচেতনতার সঙ্গেও পূজার মিল ঘটেছে।
অস্ট্রেলিয়ায় দুর্গাপুজো কেবল দেবী দুর্গার পূজা নয়—এটি প্রবাসী বাঙালির শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার, ঐতিহ্যের গর্ব ভাগ করে নেওয়ার এবং আগামী প্রজন্মকে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তুলে দেওয়ার এক মহোৎসব। দূর দেশে থেকেও এই উৎসব প্রমাণ করে, বাঙালির উৎসব চেতনা ও সমবেত আনন্দের ধারা ভৌগোলিক সীমানা মানে না; বরং যেখানে বাঙালি আছে, সেখানেই পূজার ঢাক বাজে, আলোর রঙ ছড়ায়, আর মিলনের হাসি প্রতিধ্বনিত হয়।
ছবি: সংগৃহীত