পিয়া রায়
জাপান মূলত শিন্তো এবং বৌদ্ধ ঐতিহ্যের দেশ হলেও গত কয়েক দশকে এখানে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবের ছায়া পড়েছে, যার মধ্যে অন্যতম দুর্গাপুজো। এই উৎসবটি জাপানে বসবাসরত ভারতীয় বাঙালি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে শুধুই ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং সাংস্কৃতিক শিকড়ের সাথে সংযোগ রক্ষার মাধ্যম। টোকিও, ইয়োকোহামা, ওসাকা, কিয়োটোসহ একাধিক শহরে প্রতিবছর দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়, যা মূলত ভারতীয় সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলো দ্বারা আয়োজন করা হয়। টোকিওর কোগানেই সিটিতে অনুষ্ঠিত দুর্গাপুজো বিশেষভাবে পরিচিত, যেখানে কয়েক হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে দেবীর আরাধনায় অংশ নেন। এখানকার পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—বাঙালি প্রবাসীরা নিজেরাই অর্থ সংগ্রহ করে মণ্ডপ তৈরি, প্রতিমা আনা (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কলকাতা থেকে নির্মিত হয়ে আনা হয়), এবং পূজার যাবতীয় আয়োজন করেন।
জাপানের দুর্গাপুজোতে শুধু ভারতীয়রাই নয়, স্থানীয় জাপানি নাগরিকরাও যোগ দেন। তারা উৎসবের সাংস্কৃতিক দিক যেমন নৃত্য, গান, নাটক এবং ভারতীয় খাবারের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখান। এর ফলে পুজো কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং হয়ে ওঠে দুই দেশের সংস্কৃতির বিনিময়ের সেতুবন্ধন। প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে এটি একধরনের মানসিক আশ্রয়, যেখানে দূরদেশে থেকেও নিজেদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ মেলে। পূজার দিনগুলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে অঞ্জলি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের প্রতিযোগিতা, আর ভোগ বিতরণ। ভোগের মেনুতে সাধারণত খিচুড়ি, ল্যাবরা, বেগুনি, চাটনি, পায়েসের মতো বাঙালি পদ থাকে, যা মুহূর্তে উৎসবে ‘ঘরের স্বাদ’ এনে দেয়।
জাপানে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল প্রায় চার দশক আগে, যখন স্বল্প সংখ্যক প্রবাসী বাঙালি মিলে ছোট পরিসরে পূজার আয়োজন করতেন। ধীরে ধীরে ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় আজ এটি এক বিশাল আয়োজনে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই কমিউনিটি ভিত্তিক পূজো অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো “জাপান দুর্গোৎসব কমিটি” এবং “বঙ্গ সংস্কৃতি পরিষদ”–এর মতো সংগঠন, যারা পূজোর আয়োজন নিয়মিত করে আসছে।
এই উৎসবের মাধ্যমে ভারতীয়রা যেমন নিজেদের পরিচিত শিকড়ের টান অনুভব করেন, তেমনি জাপানিদের কাছেও ভারতীয় সংস্কৃতির এক অনন্য দিক তুলে ধরেন। ফলে দুর্গাপুজো আজ আর কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং আন্তর্জাতিক মেলবন্ধনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিদেশের মাটিতে থেকে বাংলা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার এই প্রয়াসই প্রবাসী বাঙালিদের কাছে দুর্গাপুজোকে হয়ে তুলেছে অনন্য মহিমান্বিত।
ছবি: সংগৃহীত