পিয়া রায়
থাইল্যান্ডে দুর্গাপুজো একটি অনন্য সাংস্কৃতিক পরম্পরা, যা প্রবাসী ভারতীয় ও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগে আজ এক উল্লেখযোগ্য উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই দেশটি মূলত থেরবাদ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হলেও এখানে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব গভীরভাবে নিহিত। বিশেষত ব্যাংকক, চিয়াং মাই এবং পাতায়ার মতো শহরে দুর্গাপুজো আয়োজন প্রতি বছর যথেষ্ট ধুমধামের সঙ্গেই অনুষ্ঠিত হয়। ব্যাংককের বিখ্যাত শ্রী মহামারিয়াম্মান মন্দির, যা স্থানীয়ভাবে ওয়াট খেক নামেও পরিচিত, সেখানে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বিশাল আয়োজন করা হয়। দেবী দুর্গার প্রতিমা, সজ্জা, অঞ্জলি এবং আরতি থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্যন্ত—সবকিছুই এখানে অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিপুল সংখ্যক বাঙালি শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী থাইল্যান্ডে বসবাস করেন। তাঁদেরই উদ্যোগে দুর্গাপুজোর প্রচলন শুরু হয়েছিল কয়েক দশক আগে। প্রথমদিকে ক্ষুদ্র পরিসরে আয়োজিত হলেও বর্তমানে এই উৎসব প্রবাসী সমাজের অন্যতম প্রধান বার্ষিক আয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত ব্যাংককে আয়োজিত দুর্গাপুজোতে কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত হন, যার মধ্যে শুধু ভারতীয় নন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও স্থানীয় থাই নাগরিকরাও যোগ দেন। থাইল্যান্ডবাসীরা ভারতীয় দেবদেবীর প্রতি দীর্ঘদিন ধরেই শ্রদ্ধাশীল, ফলে দুর্গাপুজোর সময়ে তাঁদের অংশগ্রহণ ও কৌতূহল উৎসবকে আন্তর্জাতিক মাত্রা এনে দেয়।
দুর্গাপুজোর মূল আচার-অনুষ্ঠান থাইল্যান্ডে ভারতের মতোই। মহালয়ার মাধ্যমে দেবী দুর্গার আগমনকে স্বাগত জানানো হয়। চারদিনব্যাপী শারদোৎসবে পূজা, অঞ্জলি, ভোগ, সান্ধ্য আরতি ও সিঁদুর খেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রবাসী বাঙালিরা চেষ্টা করেন ভারতীয় ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে—ভোগের মেনুতে থাকে খিচুড়ি, ল্যাবরা, বেগুনি, চাটনি, পায়েসের মতো খাবার। পূজোর পাশাপাশি চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত, লোকসংগীত, নৃত্য, নাটক এবং শিশুদের পরিবেশনা দেখা যায়। এইসব কার্যক্রমে প্রবাসী সম্প্রদায়ের পরবর্তী প্রজন্ম ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়।
ব্যাংককের দুর্গাপুজো ছাড়াও ফুকেট ও পাতায়ার মতো পর্যটনকেন্দ্রেও বাঙালি প্রবাসীরা ছোট ছোট পরিসরে পূজার আয়োজন করে থাকেন। এসব আয়োজনে ভক্তির পাশাপাশি একটি পারিবারিক উষ্ণতা থাকে, কারণ বিদেশের মাটিতে থেকে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে উৎসব পালন করা প্রবাসীদের কাছে এক গভীর মানসিক সমর্থন হয়ে ওঠে।
সব মিলিয়ে থাইল্যান্ডে দুর্গাপুজো কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি প্রবাসী ভারতীয়দের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একইসাথে এটি দুই দেশের সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র হিসেবেও কাজ করছে। যেখানে দেবীর আরাধনায় যেমন অনুরণিত হয় ভক্তির সুর, তেমনি মিশে যায় ভারতীয় ঐতিহ্য, প্রবাসী জীবনের টানাপোড়েন এবং আন্তর্জাতিক মেলবন্ধনের অনন্য আবহ।
ছবি: সংগৃহীত