রাজীব সিকদার
স্যার, মেয়েটা চার বছর হতে চললো এখনো কথা বলছে না ঠিক মতো, স্যার উচ্চারণগুলো স্পষ্ট করা যাচ্ছে না এখনো - কয়েকটা শব্দ বেরোয় না, মেয়েদের একটু আধটু শিখলেই হলো, এত শিখে কি করবে ? ও মাধ্যমিক পর্যন্ত কোনো রকম হোক তারপর পর বিয়ে দিয়ে দেবো। এমনিতেই তো শেষ ঠিকানা তো সেই শ্বশুর ঘরের রান্না ঘর, ছেলেটা একেবারেই কথা শুনে না একগুঁয়ে স্বভাবের, যা বলবে সেটাই ও করে ছাড়বে, আর ঠিক উল্টোটা করবে, কিছুই বুঝতে পারছিনা ওকে নিয়ে কি করবো, বাড়ীতে একটু কষ্ট হয়ে গেছে, পুষ্টিকর খাবারও ঠিকমতো দিতে পারিনা, কারেন্টের যা বিল তা দিতে পারিনি বলে লাইন কেটে দিয়ে গেছে, রেশনের কেরোসিনে সারা সপ্তাহ চলে না, সন্ধ্যার আগেই যা কাজ সেরে নিই, স্কুল অনেক দূরে, পায়ে হেঁটে যেতে হয়, একজন শিক্ষক, ওতে কি আর কিছু হবে, সবে দুই বছর হলো মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি, এর মধ্যেই ওর স্বামী মারা গেলো, এক বছরের একটা বাচ্চা আছে, কি করবো এখন কিছুই বুঝতে পারছি না, মেয়েটার যদি আরেকবার বিয়ে দেওয়া যায়, কেউ করবে কিনা, কে কি আবার বলবে, ছেলেটাকে পড়তে পাঠিয়েছি কলকাতায়, ঠিক মতো টাকা পয়সা পাঠাতে পারিনা, কি জানি কি করে চালাচ্ছে, ওর থাকার জায়গাটা ভালো নয়, একটা সামান্য জায়গা ওতেই ঠাসাঠাসি করে থাকে, সকালে কলেজ করে আর বিকালে একটা পার্ট টাইম কাজ করছে, কি যে পড়ছে কে জানে, এখন যা সিলেবাস, মাথামুন্ডু নেই, কম্পিউটার এসে এখন আর কেউ লিখতে পড়তে চাইছে না, সবই কম্পিউটারে হয়ে যাচ্ছে, একটা কথা বললে উত্তর আসে না, একটা লিখতে বললে লেখার কোনো ইচ্ছেই নেই, গাদা খানেক বানান ভুল, ভালো করে গুছিয়ে কথাটাও শেখেনি ইত্যাদি শত শত প্রশ্ন আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে পশ্চিমবাংলার উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা গ্রামগুলোর হত দরিদ্র - অসহায় অভিভাবকদের কাছে, মফঃস্বলে - শহরের নিম্নবিত্ত - মধ্যবিত্তের পরিবারের অসহায় মানুষের মুখে মুখে। যার সব কিছুরই উত্তর বিদ্যাসাগর তার নিজের জীবন সংগ্রাম ও কাজের মাধ্যমে দিয়েছেন ।
জীবন যত প্রতিকূল হয়েছে জীবন পরিচালনাও যেনো সাবলীল করে তুলেছিলেন বিদ্যাসাগর। বোধহয় আলাদা করে কষ্টের অনুভূতি তিনি বুঝতেই চাননি। ঠিক যেমন পরিস্থিতি তেমনই সমাধান পরিকল্পনা। যানবাহন যেখানে নেই রাস্তা খারাপ তিনি নিজের পায়ের উপর ভরসা রেখেছেন। লিখতে পড়তে বলতে শেখার জন্য অক্ষর, শব্দ , বাক্য সৃষ্টি করে ফেললেন। শিশু মন বুঝে উচ্চারণ পদ্ধতি ও ভঙ্গিমাটা ঠিক করে দিলেন। সকল শিশুকে সমান গুরুত্ব দিলেন। নিজের জীবনে আলো জ্বালানোর উপকরণ নেই তো রাস্তার আলো কাজে লাগিয়ে নিলেন। মা কে ছেড়ে কলকাতায় এসেছে তো, তাই বাবার সাথেই দৈনন্দিন কাজে হাত লাগালেন। এরই সাথে পড়াশোনা। নিজের কাজ নিজেই করে নেওয়ার মনন যেনো তাকে অজেয় পৌরুষের জায়গায় স্থান দিয়েছিল। থাকবার জায়গা যত ছোটো হোক না, কোনো কিন্তুই তাঁর মনে আসেনি। সামান্য জায়গাতেই মাথা গুঁজেছেন। এভাবেই চলেছে জীবন। যাঁরই কষ্ট তিনি দেখেছেন সাধ্য অনুযায়ী নিজের যা কিছু তাকে দিয়ে দিয়েছেন। পরিচিত হয়ে গেছিলেন একজন দয়ালু মানুষ হিসাবে।
একদিকে যা কিছু শিখছেন , অন্যদিকে তা অন্যকে শেখাচ্ছেন। সমাজের কুৎসিত সংস্কারের চাপে মেয়েদেরকে তিনি অবলা জাতি হিসাবে অনুভব করেছিলেন। তাঁদের সবলা করার জন্য তৎপর হয়েছিলেন। অল্প বয়সী মেয়ের পতি বিয়োগে তিনি কোনো সংস্কারে আচ্ছন্ন হননি, সমাজের বৈধব্য সংস্কারে আমল দেননি। নির্দ্বিধায় স্বামী হারা সেই মেয়ের আবার বিয়ের ব্যবস্থার কথা বলেছেন সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে। ধারাবাহিক লড়াইয়ে আইনি সমাধান করতে তৎপর হয়েছিলেন। তৈরী হয়েছিল বিধবা বিবাহ আইন।
কর্মজীবনে নানান সহকর্মীর তিনি ছিলেন সহযোগী শক্তি। আপদে বিপদে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসার জন্য নিজে কাঁধে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছেন। সুস্থ করে ফিরিয়ে এনেছেন। আজও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা পরিষেবা ক্ষেত্রগুলোতে কর্মচারীদের স্বার্থপরতা কিম্বা খেয়খেয়ীর মাঝে বিদ্যাসাগরের কর্ম চঞ্চল - সহযোগী মনন সৎ - নির্ভীক - দক্ষ - সৃষ্টিশীল - দয়ালু -কর্মক্ষম জীবন একটা জ্বলন্ত উত্তর । আমলা কিম্বা শাসকদলের বশংবদ আধিকারিক বা জনপ্রতিনিধি সকলের অনৈতিক হুকুমদারির উপর সততা - কর্ম দক্ষতার - উন্নত নৈতিকতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সেই বিদ্যাসাগরের কর্ম জীবন। যিনি ড. ব্যালান্টাইনের শিক্ষা সংক্রান্ত অবৈজ্ঞানিক নির্দেশের বিরুদ্ধে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রসময় দত্তকে বলেছিলেন, 'বলো, বিদ্যাসাগর আলু পটল বেচে খাবে '। আর সে কাজ করেননি। পুত্র ও স্ত্রীর সঙ্গে পরিবারিক অশান্তি ও পরবর্তী সময়ে দিনময়ী দেবীর মৃত্যুর পর তিনি যন্ত্রণা ভোলার জন্য গিয়েছেন সেই দরিদ্র আদিবাসী গ্রাম কার্মাটাড়ে । সেখানে তাঁদের সাথে থাকতে থাকতে তাঁদেরই একজন হয়ে গেছেন। কিন্তু, তিনি কোনোদিনই কোনো সমস্যায় পড়লে সমাধান খুঁজতে বড়লোকের দ্বারস্থ হননি কিম্বা মন্দিরে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করে সমাধান খোঁজেননি। প্রতিকূল পরিস্থিতিকেও অনুকূলে রূপায়িত করেছেন। পর্যাপ্ত জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা ও জ্ঞান লাভ, উন্নত নৈতিকতা, চারিত্রিক বলিষ্ঠতা, অসীম ধৈর্য্য আর পরিপূর্ণ মর্যাদাবোধ তাঁকে পরিণত করেছিল এক অপরাজেয় শক্তিতে । তাঁর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নানান সমস্যার সমাধান সূত্রগুলো যেনো আজও সহায় সম্বলহীন মানুষের জীবনে মূলধন। আমরা যদি সামান্য হলেও বিদ্যাসাগরের জীবনকে জানবার, বুঝবার, উপলব্ধি করবার চেষ্টা করি তাহলে হয়তো যেকোনো কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতিতে তিনিই হতে পারেন মাথা তুলে বাঁচবার পথের দিশারী এবং নিম্নবিত্ত, অসহায় ও দরিদ্রের মুশকিল আসান।