আর বিপ্লব
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপির উপস্থিতি এক দশক আগেও প্রান্তিক ছিল। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র একটি আসনে জয় পেয়ে যে দলটি নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারেনি, সেই দলই ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন দখল করে রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ আমূল বদলে দেয়। এরপর থেকেই বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কার্যকলাপ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি এই দলকে রাজ্যের প্রধান দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে? এই প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষণের কেন্দ্রে।
বিজেপির উত্থানের অন্যতম কারণ ছিল তৃণমূল-বিরোধী জনমতকে একত্রিত করা। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থার সুযোগে বিজেপি নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে তুলে ধরে। বিশেষত উত্তরবঙ্গ, জঙ্গলমহল, ও কিছু শহুরে এলাকায় তারা দ্রুত জনভিত্তি গড়ে তোলে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আগ্রাসী প্রচার, নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, এবং হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের বার্তা—এসব মিলিয়ে তারা ভোটশেয়ারে বড়সড় অগ্রগতি করে।
তবে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়া বিজেপির জন্য সতর্ক সংকেত ছিল। যদিও তারা ৭৭টি আসনে জয় পায়—যা পশ্চিমবঙ্গে তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ—তবুও তৃণমূল কংগ্রেস ২০০-র বেশি আসন পেয়ে ক্ষমতা ধরে রাখে। এরপর থেকে বিজেপির সংগঠনমূলক স্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অনেক শীর্ষ নেতা তৃণমূলে ফিরে গেছেন, আবার কিছু জেলায় সাংগঠনিক ভাঙন ঘটেছে।
সাম্প্রতিক কার্যকলাপে বিজেপি রাজ্য সরকারের দুর্নীতি, নিয়োগ কেলেঙ্কারি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ও কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতকে মূল ইস্যু করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। সিবিআই ও ইডি তদন্তকে তারা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বলে বিরোধীরা অভিযোগ তুললেও, বিজেপি দাবি করছে—এটি দুর্নীতি দমনের প্রক্রিয়া। তবে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার অতিরিক্ত সক্রিয়তা অনেক ভোটারের কাছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে ধরা পড়তে পারে, যা দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বিজেপির একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্থানীয় নেতৃত্বের অভাব। রাজ্যের অধিকাংশ শীর্ষ নেতা এখনও তুলনামূলকভাবে নতুন বা অন্য দল থেকে আসা। দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি, ফলে গ্রামীণ ভোটারদের মধ্যে সাংগঠনিক আস্থা গড়ে তুলতে সময় লাগছে। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের বহুত্ববাদী সামাজিক কাঠামো ও বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কিছুটা অসঙ্গতি আছে, যা সংখ্যালঘু এবং উদারপন্থী ভোটারদের দূরে রাখছে।
তবে বিজেপির শক্তির জায়গা উপেক্ষা করা যাবে না। উত্তরবঙ্গ, জঙ্গলমহল, এবং কিছু সীমান্তবর্তী এলাকায় তারা তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটিতে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়েছে। চা-শ্রমিক, আদিবাসী ও কিছু সংখ্যক যুব ভোটারদের মধ্যে তাদের সমর্থন বাড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প—যেমন উজ্জ্বলা যোজনা, আবাস যোজনা, এবং গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন—গ্রামীণ ভোটারদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আগামী দিনে বিজেপি রাজ্যের প্রধান দল
হতে চাইলে তাদের কয়েকটি ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দিতে হবে—
প্রথমত, স্থানীয় নেতৃত্বকে শক্তিশালী করে
দীর্ঘমেয়াদি সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা।
দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র ধর্মীয় মেরুকরণের বাইরে
গিয়ে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও শিল্প বিনিয়োগের মতো ইস্যুকে
প্রচারের কেন্দ্রে আনা।
তৃতীয়ত, সংখ্যালঘু ও শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটারদের
আস্থা অর্জনে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া।