আর বিপ্লব
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপির উত্থান সাম্প্রতিক কালের অন্যতম আলোচিত বিষয়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ১৮টি আসন দখল করে দলটি এক অভূতপূর্ব অগ্রগতি দেখায়। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসে, যা এক দশক আগেও অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু এই দ্রুত উত্থান সত্ত্বেও, রাজ্যের একটি বড় অংশ এখনও বিজেপির উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে প্রস্তুত নয়। এর পেছনে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, সামাজিক বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক কৌশলের নানা দিক, যা দলটির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বামপন্থী ভাবধারার দ্বারা প্রভাবিত। স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে নকশাল আন্দোলন, ছাত্র রাজনীতি এবং বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনকাল—সবই রাজ্যের রাজনৈতিক মনের গঠন তৈরি করেছে। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ অনেক ভোটারের কাছে এই ঐতিহাসিক ভাবমূর্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায়। ফলে দলটির বার্তা, যা উত্তর ও পশ্চিম ভারতে সহজে গ্রহণযোগ্য, বাংলার একাংশে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে “বহিরাগত ভাবমূর্তি”র সমস্যা। বাংলায় বিজেপি এখনও অনেকের চোখে উত্তর ভারতকেন্দ্রিক দল, যার নেতৃত্ব, প্রচারের ধরন ও সাংগঠনিক কাঠামো মূলত হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে। আঞ্চলিক পরিচয়ে গর্বিত ভোটারদের কাছে এই ভাবমূর্তি দূর করা কঠিন। যখন প্রচারে “বাংলা বনাম বহিরাগত” প্রশ্ন সামনে আসে, তখন তৃণমূল কংগ্রেস এই ইস্যুকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে বিজেপিকে প্রতিরক্ষায় ঠেলে দেয়।
সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের বিরূপতা বিজেপির জন্য আরও বড় বাধা। রাজ্যের প্রায় ২৭% মুসলিম ভোটারদের একটি বড় অংশ বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণমূলক রাজনীতিকে অবিশ্বাস করে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) প্রসঙ্গে দলের অবস্থান এই অবিশ্বাস আরও গভীর করেছে। নির্বাচনে এই ভোটব্যাঙ্ক প্রায় সর্বসম্মতভাবে বিজেপিবিরোধী শিবিরে যায়, যা গ্রামীণ ও সীমান্তবর্তী আসনগুলিতে দলের সম্ভাবনাকে সীমিত করে।
স্থানীয় নেতৃত্বের দুর্বলতাও বিজেপির অগ্রগতির পথে অন্তরায়। দলের অধিকাংশ প্রভাবশালী মুখ অন্য দল থেকে যোগ দিয়েছেন, যার ফলে সংগঠনের ভিত এখনও অস্থির। দীর্ঘদিনের গ্রাসরুট সংগঠন না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে দলের উপস্থিতি ভোটের সময়েই দৃশ্যমান হয়, যা তৃণমূলের মতো গভীরভাবে প্রোথিত সংগঠনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দুর্বলতা সৃষ্টি করে।
রাজ্যে তৃণমূলের আক্রমণাত্মক প্রতিরোধও বিজেপিকে চাপে রাখে। তৃণমূল কংগ্রেস গ্রামীণ স্তরে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিজেপির প্রচার সীমিত করে এবং রাজনৈতিক সহিংসতা ও সাংগঠনিক প্রতিযোগিতায় দলটিকে কোণঠাসা করে। ফলে বিজেপির বার্তা অনেক সময় ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর আগেই প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নিয়েও অসন্তোষ বিজেপির উপর আস্থা তৈরিতে বাধা। কৃষি আইন, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সংকট এবং বেসরকারীকরণ নীতি নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলায়ও প্রভাব ফেলেছে। অনেকেই মনে করেন, কেন্দ্রের নীতি রাজ্যের স্বার্থ রক্ষায় যথেষ্ট নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
নির্বাচনী প্রচারে অতিরিক্ত ধর্মীয় মেরুকরণও সমস্যা তৈরি করেছে। রামমন্দির, গোরক্ষা, কিংবা CAA-র মতো ইস্যুগুলির উপর অতিরিক্ত জোর অনেক শিক্ষিত শহুরে এবং তরুণ ভোটারের কাছে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের আলোচনাকে আড়াল করে দিয়েছে। বাংলার রাজনৈতিক ঐতিহ্যে যুক্তি ও সংস্কৃতিনির্ভর বিতর্কের স্থান বেশি; অতিরিক্ত ধর্মীয় আহ্বান সেখানে অনেক সময় প্রতিকূল ফল দেয়।
সবশেষে, বাঙালি পরিচয়ের সংকটের আশঙ্কা—এটিও এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অনেকে বিশ্বাস করেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে কেন্দ্রীয়করণ বাড়বে, এবং রাজ্যের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গুরুত্ব কমে যাবে। এই আশঙ্কা বিশেষ করে সংস্কৃতিমনস্ক মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সমাজে দৃঢ়, যারা আঞ্চলিক পরিচয়কে রক্ষা করাকে রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের অংশ মনে করেন।
সব মিলিয়ে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পথে মূল বাধা শুধু নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়; বরং সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রোথিত কিছু কারণ। যদি দলটি এই রাজ্যে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তি গড়তে চায়, তবে তাকে শুধু সংগঠন সম্প্রসারণ নয়, বরং বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ তৈরি করতে হবে। অন্যথায়, সংখ্যাগত অগ্রগতি সত্ত্বেও পূর্ণ আস্থা অর্জন করা কঠিন হবে, এবং রাজনীতির মঞ্চে বিজেপি “বিরোধী” শক্তি হিসেবেই আটকে থাকতে পারে, শাসনক্ষমতার স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই।