শম্ভুনাথ রায়
"............নজরুল কি করে রাশিয়ার স্বাধীনতার খবর পেয়েছিল। আমাদের ব্যারাকের কর্তৃপক্ষের শ্যেন দৃষ্টি ছিল যাতে আমরা বাইরে থেকে কোনো রকম রাজনৈতিক খবর না পাই। সে জন্য পত্র পত্রিকা যা আসতো তা পরীক্ষা করে আমাদের দেওয়া হত। তা সত্ত্বেও "বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো ' র মত হওয়ার দরুন ও সব খবরাখবর কি করে জোগাড় করত সেই জানে।
নজরুলের আড্ডা থেকেই সে বাছাই করা কয়েকজনকে সে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সংবাদ দিত। যেমন আইরিস বিদ্রোহ ও রুশদের কথা। আমরা কয়েকটি বন্ধু এসব বিষয়ে যেমন সাবধানতার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতাম নজরুল তার ভাবকে তেমন চেপে রাখতে পারত না। অবশ্য তার একটা পথ ছিল, গান ও কবিতার সাহায্যে, সে গান গেয়ে ও কবিতা পড়ে তার ভাবকে ব্যক্ত করত। সৈন্যদের মধ্যে এসব নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামাত না।
একদিন সন্ধ্যায় ১৯১৭ সালের শেষের দিকেই হবে, এখন ঠিক স্মরণে আনতে পারছি না, হয়তো সেটা শীতের শেষের দিক। নজরুল তাঁর বন্ধুদের মধ্যে যাঁদের বিশ্বাস করতেন, তাঁদের এক সন্ধ্যায় খাবার নিমন্ত্রণ করে। অবশ্য এরকম নিমন্ত্রণ প্রায়ই সে তার বন্ধুদের করত। কিন্তু ঐ দিন যখন সন্ধ্যার পর তার ঘরে আমি ও নজরুলের অন্যতম বন্ধু, তার অর্গান মাস্টার হাবিলদার নিত্যানন্দ দে প্রবেশ করলাম, তখন দেখলাম অন্যান্য দিনের চেয়ে নজরুলের চোখেমুখে একটা অন্যরকম জ্যোতি খেলে বেড়াচ্ছিল। উক্ত নিত্যানন্দ দে মহাশয়ের বাড়ি ছিল হুগলী শহরের ঘুটিয়াবাজার নামক পল্লীতে। তিনি অর্গানে একটা মার্চিং গৎ বাজানর পর সেই দিন নজরুল যে সব গান গাইলেন ও প্রবন্ধ পড়লেন তা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে রাশিয়ার জনগণ জারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। গান বাজনা প্রবন্ধ পাঠের পর রুশ বিপ্লব সম্বন্ধে আলোচনা হয় এবং লাল ফৌজের দেশপ্রেম সম্পর্কে নজরুল খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এবং ঠিক মনে নেই, সে গোপনে আমাদের একটি পত্রিকা দেখায়। ওই পত্রিকাতে আমরাও বিশদ ভাবে সংবাদটি পড়ে উল্লসিত হয়ে উঠি। সেদিন সারা রাতই প্রায় হৈ হুল্লোড়ে আমাদের কেটে গিয়েছিল।
কাজী যে কাজ আরম্ভ করতো তা শেষ না করে ছাড়ত না। তাই যে লেখা সে পল্টনে যাবার আগেই আরম্ভ করেছিল সে অভ্যাস সে সমস্ত পল্টনের জীবনেই চর্চা করে গেছে। এত যার আনন্দ এত যার উৎসাহ যে " নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের" মতই উচ্ছ্বসিত আজ সে নিস্তব্ধ । ভগবানের কি ইচ্ছা কে জানে !"
তথ্যসূত্রঃ ( নজরুলের সেনা ব্যারাকের সহকর্মী - বন্ধু শম্ভু রায়ের পত্রাবলী / প্রানতোষ চট্টোপাধ্যায় (১৩৬২ বঙ্গাব্দ ) : কাজী নজরুল, কলকাতা, পৃষ্ঠা : ২৯০-২৯১
তথ্যসংগ্রহ ও সম্পাদনা : রাজীব সিকদার , কলকাতা