পিয়া রায়
রাশিয়ার দুর্গাপুজো বাঙালি প্রবাসী সমাজের এক অনন্য পরিচয় বহন করে। প্রবাসে থেকেও শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রবল আকাঙ্ক্ষা এবং সাংস্কৃতিক চেতনা মিলেমিশে এই উৎসবকে নতুন প্রজন্মের কাছে উপহার দিচ্ছে। মূলত মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গকে কেন্দ্র করেই দুর্গাপুজোর আয়োজন হয়, যেখানে ভারতীয় প্রবাসী, বিশেষ করে বাঙালিরা, প্রতি বছর অসীম উদ্দীপনা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। মস্কো দুর্গাপুজো কমিটি ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নিয়মিত এই পূজার আয়োজন করছে। প্রবাসে এই পূজো শুরু হয়েছিল খুবই ছোট পরিসরে, সীমিতসংখ্যক ভক্ত ও উৎসাহী মানুষদের নিয়ে। কিন্তু বর্তমানে এটি শুধু বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ থেকে শুরু করে রাশিয়ান নাগরিকেরাও এই উৎসবে যোগ দেন।
দুর্গাপুজো রাশিয়ার মাটিতে অনেক সময়ই প্রতীকী রূপ নেয়। কলকাতার মতো বিশাল প্যান্ডেল বা আলো-সজ্জার সুযোগ না থাকলেও এখানে থাকে ভক্তির উচ্ছ্বাস আর মিলনের আনন্দ। মস্কোতে দুর্গাপুজো সাধারণত ভারতীয় দূতাবাসের সক্রিয় সহযোগিতায় হয়। ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক বরাবরই দৃঢ়, আর এই ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সেই কূটনৈতিক ও সামাজিক সেতুবন্ধনকে আরও মজবুত করে। পূজো মঞ্চে মাটির প্রতিমা পাওয়া কঠিন হওয়ায় অনেক সময় ফাইবারগ্লাস বা অন্য উপকরণ দিয়ে তৈরি প্রতিমা ব্যবহার করা হয়, যা স্থানীয় শিল্পীরা বা ভারত থেকে আনা শিল্পীরা তৈরি করে থাকেন।
উৎসবের আবহে পূজার আনুষ্ঠানিকতা যেমন অঞ্জলি, আরতি, ধুনুচি নাচ, সিঁদুর খেলাই থাকে, তেমনি সমান্তরালভাবে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, আধুনিক বাংলা গান থেকে শুরু করে নাটক ও নৃত্যানুষ্ঠান—সবই থাকে এই আয়োজনে। প্রবাসী শিশু-কিশোররা অংশ নেয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনায়, যা তাদের মাতৃভূমির সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করে। রাশিয়ার নাগরিকদেরও এই আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো হয়, ফলে উৎসবটি এক আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করে। দুর্গাপুজোর প্রাঙ্গণে ভোজনপর্বও এক অনিবার্য অঙ্গ—খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েস প্রবাসে থেকেও বাঙালির ভোজনরসিকতাকে পূর্ণতা দেয়।
সেন্ট পিটার্সবার্গেও দুর্গাপুজো ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেখানকার বাঙালি সম্প্রদায় প্রবাস জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও পূজো আয়োজন করেন, যাতে সবাই একত্র হতে পারেন। এভাবে দুর্গাপুজো প্রবাসী বাঙালির জন্য কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং হয়ে ওঠে সামাজিক মিলনক্ষেত্র। উৎসবকে ঘিরে আবেগ এতটাই প্রবল যে, দুর্গাপুজো উপলক্ষে অনেকেই বিশেষভাবে ছুটি নেন, ভ্রমণ করেন দূর শহর থেকে।
রাশিয়ার দুর্গাপুজো তাই শুধু ভক্তির প্রকাশ নয়, বরং প্রবাস জীবনের আবেগময় কাহিনি। এখানে পূজো মানে নিজের শিকড়ের টানকে পুনর্জীবিত করা, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া এবং সন্তানদের কাছে বাঙালিয়ানার আবহ পৌঁছে দেওয়া। বিশ্বজুড়ে যেমন দুর্গাপুজো এক আন্তর্জাতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে, রাশিয়াতেও তা ধীরে ধীরে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। সীমিত পরিসরেও এই আয়োজন প্রমাণ করে যে, উৎসব কেবল ভূগোলের সীমারেখায় আবদ্ধ নয়; বরং এটি বাঙালির চেতনা ও সংস্কৃতির চিরন্তন বহিঃপ্রকাশ, যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বেঁচে থাকে মানুষের মনে ও সমাজের আবহে।
ছবি: সংগৃহীত